Wednesday, August 15, 2018

হাতুড়ির নিচে জীবন - রফিক আজাদ


হাতুড়ির নিচে জীবন
- রফিক আজাদ

নানান রকম হাতুড়ির নিচে এই জীবন।
নানান রকম হাতুড়ি উঠে এসে পড়ছে তোমার মাথায়,
নানা - রঙ পোশাক পরা হাতের হাতুড়ি,
হাতুড়ি ধরা দৃঢ় ভিন্ন-ভিন্ন হাতগুলোর 
উদ্দেশ্য কিন্তু এক ও অভিন্ন
তোমাকে নিস্পিষ্ট করা, 
নির্মূল করা,
এই হাতুড়িগুলি ধরে আছে যে হাতগুলো
 তাদের মালিকেরা কেউ চক্রাবক্রা, কেউবা এক রঙ।

 ছোট বড় নানা মাপের, নানা হাতের 
হাতুড়িই নির্দিষ্ট আছে তোমার জন্যে
জন্ম-মুহূর্তে থেকে। হাতুড়ির ঘা - খাওয়া থেকে 
নিষ্কৃতি নেই।
এমন কি, তোমার পছন্দ মতো হাতুড়ির আঘাত
তুমি বেছে নিতে পারোনা।
তোমার জন্যে 
বরাদ্ধকৃত হাতুড়িটি অন্যেরাই বেছে নেবে। 
তুমি শুধু মাথা পেতে থাকার স্বাধীনতাটুকু 
ভোগ করতে পারে। হায় স্বাধীনতা !
‘স্বাধীনতা’ শব্দটি কেবল নানা বর্ণের, নানা মাপের 
পোশাক পরিহিত লোকেরাই নির্বিচারে 
ব্যবহার করতে পারবেন,
তোমার কপালে বরাদ্ধকৃত শাস্তিটুকু কেবল মাথা পেতে 
নেয়ার স্বাধীনতা থাকবে তোমার।
স্বাধীনতার ফসল ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে, 
তুমি তুলে নিতে পারবে না নিজে সেই শস্য!
আমাদের পূর্বে - পুরুষেরা ছিলেন পরাধীন।
কিন্তু তাদের অধিকারে  ছিলো ইচ্ছের স্বাধীনতা, 
স্বাধীনতার সৈনিক তুমি, অথচ তোমার নেই
সেই স্বাধীনতা।

তারকাঁটার মতো তুচ্ছ এই জীবন,
তোমার মাথা যেন তারকাঁটার ছাঁদ,
তারকাঁটাদের জন্ম-মৃত্যুর রহস্য নেই কোনো, 
জন্মই হয় ওদের নিস্পিষ্ট হতে
হাতুড়ির নিষ্পেষণের জন্যে তোমার ঐ মাথা 
সর্বদাই তৈরি থাকবে 
এমন একটা দলিলে স্বাক্ষর করেই যেন 
তোমার জন্ম
নানা রকমের হাতুড়ি আছে এই দেশে, এ সমাজে,
স্থানীয়ভাবে প্রচুর পরিমাণ হাতুড়ির উৎপাদন
হওয়া সত্বেও কিছু সংখ্যক মসৃণ হাতুড়ির জন্যে 
আমদানী লাইসেন্স ইস্যু হয় ফি - বছর,
তোমার মাথায় ব্যবহার হেতু 
প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে আনা হয়েছে 
বেশ কিছু সংখ্যক সুমসৃণ বিদেশী হাতুড়ি 
যার আছাড়িটুকু তৈরি হয় মূল্যবান ওক কাঠে,
উল্লেখ্য যে, একিলিসের বর্শার হাতলও ছিলো
ওক কাঠের তৈরি।

তাইতো, হাতুড়ির নিচে জীবন যাদের 
তাদের কথা বিস্তারিতভাবে বলার কিছু নেই 
তারা এতো অনুল্লেখ্য  যে, উল্লেখের কোন 
প্রয়োজনই বোধ করে না কেউ - এমনকি তারা
নিজেরাও নয়।
এই যখন অবস্থা, তখন 
বিদেশী হাতুড়ির জন্যে তৈরি যোগ্য 
মুন্ডুর সংখ্যা 
দিন - কে দিন বেড়েই যাচ্ছে ! অনুরূপভাবে 
দেশীয় হাতুড়িশিল্পের উৎপাদনও বাড়ছে
                    পাল্লা দিয়ে।
নানা রকম পোশাক-পরা হাতে তো হাতুড়ি 
                          ধরিয়ে দিতে হবে।
হাতুড়ির ওঠা -পড়ার শব্দে চমকিত চারদিক, 
তোমার মাথায় এসে পড়া হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে 
ওজন বুঝে তুমি বলে দিতে পারো এ - কার হাতুড়ি!
নানা রকমের আঘাতই তো পড়ছে এই মাথায় আজকাল।
অনেকগুলো দেশী
হাতুড়ির বাড়ি খেয়ে যখন ঝিম মেরে আছো, 
ঠিক এই সময়ে মসৃণ একটা ঘা পড়লো এসে 
তোমার মাথায় - তত্মুহূর্তেই কেন যেন
জীবনের সবচেয়ে প্রাণঘাতী চিৎকারটিই 
দিয়ে উঠেছো তুমি।
পাথরের আঘাতে যে অভ্যস্ত
তাকে সহসা একটি বকুল ফুলের মালা 
ছুড়ে দিয়ে দেখো কী হয় অবস্থা তা !
তবেই মসৃণ আঘাত যে কতো মারাত্মক,
সে সম্পর্কে সত্যিকার উপলদ্ধি হতে পারে তোমার!
অবশ্য একথা সত্য যে, সবধরনের হাতুড়ির নিচে 
মাথাটি  পেতে দিতে পারাতেই তোমার এই  
জীবনের সার্থকতা!!

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>



এই কবিতা সম্পর্কে একটি খন্ড বক্তব্য: কবি বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় নয় এটা। আবার কবির কবিতাই তো সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ। এরশাদের সামরিক নিপীড়নের কালে কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’। মাত্র তিন শব্দের বাক্য দিয়ে কবি যা বুঝিয়েছেন, লক্ষ শব্দ লিখেও তা বোঝানো কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। যখনই লেখা হোক, বহু বছর বা যুগ পরেও তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বারবার।-গোলাম মোর্তোজা (www.thedailystar.net, আগস্ট ১৩, ২০১৮)