Tuesday, March 26, 2019

নীতি-কবিতা : বাংলা কবিতার হারিয়ে যাওয়া সম্পদ

- মু হা ম্মা দ হা বী বু ল্লা হ 


            এক সমাজব্যবস্থা থেকে অন্যতর ও উন্নততর সমাজব্যবস্থার দিকে অভিযাত্রা এবং কালো সভ্যতা থেকে ভালো সভ্যতা অভিমুখে যাত্রার জন্যই নানা কালপর্বে নৈতিক বাণী, লোকধর্ম, ধর্ম, দর্শন, দর্শনজাত রাজনৈতিক আদর্শ ও মতাদর্শের সৃষ্টি। যুগ-যুগান্তরে নীতির জন্ম হয় মানবসমাজ ও সমাজজীবনের অভিজ্ঞতার পরিণতি থেকে, পরিণতি থেকে অর্জিত শিক্ষার পথ ধরে। ব্যক্তির জন্ম হয় নীতির ওপর, কিছুটা বেড়েও ওঠে সে নীতির ওপর। কিন্তু পরে বিকশিত হওয়ার পথে, বিশেষ করে দ্বান্দ্বরক্তিম আধুনিক জীবনে নীতিকে বিশাল বাধা মনে করে। প্রতিটি মানুষের ভেতরে কোনো না কোনোভাবে, জীবনের কোনো না কোনো কালপর্বে, নীতিবোধ, নীতিভাবনা, নীতিগ্রহণ ও নীতিপ্রচারের তাড়না এবং প্রেরণা থাকে। নীতিবোধ ও নীতিভাবনা প্রত্যেক মানুষের ভেতর, বোধহয়, জীবিত ও জাগ্রত থাকে আজীবন। কিন্তু নীতিগ্রহণ ও নীতিপ্রচারের প্রবণতা থাকে না বেশিদিন। প্রত্যেক ব্যক্তির নীতিবোধ ও নীতিভাবনা শক্তিতে-স্বচ্ছতায় এক ও সমগোত্রীয় নয়। মানুষের মনের গভীর প্রকোষ্ঠে নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিকতাবোধ পথসঙ্গী হয়ে চলাচল করে। একটি সূক্ষ্ম-সুগভীর অধ্যাত্মবোধ ছাড়া শিল্পচর্চা হয়ে ওঠে না। বিশেষ করে ললিতকলার উপাসনা হয় না। কারণ, সূক্ষ্ম রসানুভূতির পথ ধরেই মানুষের মধ্যে শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস ও প্রেরণা জেগেছিল একদিন; এখনও জাগে; জাগবেও চিরদিন। ফলে শিল্পসাধককে—নিজের সঠিক পথটিতে চলার জন্য অধ্যাত্মসাধক হতেই হয়। আধ্যাত্মিকতার আদর্শ যে গ্রহণ করে না এবং অধ্যাত্মবোধ (ব্যাপকার্থে; কোনো বিশেষ ইজমের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়) যার ভেতর জাগ্রত হয়নি, তার জন্য ললিতকলা চর্চা করতে যাওয়া এক ধরনের কষ্টকল্পনা ও বিড়ম্বনা। কারণ জীবনকে বা পুরো জগতকে অধ্যাত্মভাব ও বোধ নিয়ে দেখলেই সবকিছুর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রসঘন সত্তা অনুভব করা যায়। আর এ সত্তাকে যিনি যত বেশি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি কথাস্রষ্টা হিসেবে তত বেশি সার্থক। এই নীতিবোধের কারণেই সমইজমের মানুষরাও একসময় পরস্পর পৃথক হয়ে যায়, ভিন্ন পথে ও মতে পা বাড়ায়। প্রত্যেকে চলে যে যার পথে। শুরু হয় তর্ক। নীতি-নৈতিকতাহীন জীবনের চেয়ে জড় হওয়াকে ভালো মনে করেছেন অনেকে। তাই বাহাদুর শাহ্ জাফরের কবিতায় অভিমান অভিনীত হয় এভাবে : ‘মানুষ হইয়া হ’ল না যখন মানুষের মত মন/ভাল হ’ত যদি হয়ে জড়মতি রহিতাম আমরণ’ (অনুবাদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)। 

          কাব্যসাহিত্য বিষয়ে ও আঙ্গিকে বহুশাখায়িত। তার শাখাসমূহের অন্যতম হলো নীতি-কবিতা। আধুনিকতার দুর্দম দাপটে মানুষের জীবন ও জীবনের সবকিছু এখন সংজ্ঞাহীন-প্রজ্ঞাহীন। মানুষ আজ সংজ্ঞার ছকে ফেলে কোনো কিছুকে বুঝতে চেষ্টা করে না এবং বোঝানোর চেষ্টা করা হলে সে বিরক্ত হয়। তথাকথিত অচলায়তন বা বৃত্ত ভাঙার যুদ্ধে এখন সবাই মত্ত। সুতরাং নীতি-কবিতার তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও একাডেমিক সংজ্ঞার পথ ধরে না এগিয়েও আমরা বলতে পারি—গল্প, কাহিনী, কাহিনী-খণ্ড বা নিছক কলাশিল্পের মাধ্যমে কবি জ্ঞানগর্ভ নীতিকথা বা তত্ত্বকথা প্রচার করে থাকেন। এজাতীয় কবিতাকে নীতি-কবিতা বলা যায়। তবে জ্ঞানের কথা, নীতির কথা বা তত্ত্বকথা কাব্য-সুষমায় মণ্ডিত হতে হবে। তা না হলে এ ধরনের কবিতা ব্যর্থ হতে বাধ্য। নীতি-কবিতায় কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও পরোক্ষভাবে কিংবা রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে মানবসমাজের কল্যাণার্থে আদেশ-উপদেশ বা নীতিকথা প্রকাশিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, উপদেশকথা ও নীতিকথার বিবরণ মানেই কবিতা নয়। অসাধারণ বাণীবদ্ধ কথামালাও সবসময় কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। দেহসৌষ্ঠবের লাবণ্যের অন্তরালে প্রাণৈশ্বর্যপূর্ণ একটি আত্মাও থাকতে হয় কবিতায়। আত্মার প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতার রমণীয়তা, রসময়তা ও রহস্যময়তার সৌন্দর্য। ব্যক্তি এবং সেই সূত্রে পুরো সমাজ নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নৈতিক কদাচারের সংশোধনের লক্ষ্যে অনুশাসনতুল্য পথনির্দেশক বাণী বা উপদেশকে বুকে নিয়ে এ জাতীয় কবিতার জন্ম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগ্রন্থে মূল মর্ম আলোচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্বের মানুষকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে, সর্বোপরি সুনাগরিক ও সভ্যরূপে গড়ে তোলার জন্য নবী-রাসুল, শ্রেষ্ঠ মনীষী ও মহাপুরুষদের বাণী, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শিক্ষণীয় কাহিনীর আদর্শ, সেই সঙ্গে সাধারণ নীতিগ্রন্থ ও প্রবাদ-প্রবচন প্রবল শক্তি ও মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সেই সূত্র ধরে পরবর্তী যুগে নীতি-কবিতা বা উপদেশমূলক কবিতার উদ্ভব ও বিকাশ। ফলে কাব্যসাহিত্যের এই শাখাটির শক্তি উল্লখযোগ্যভাবে কার্যকর। তা না হলে প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের সকল দেশে ও সাহিত্যের তার গৌরবদীপ্ত প্রচলন এবং ভূমিকা থাকত না। আজকে যে আমরা বাউল ও মরমী দানের প্রতি শিক্ষিত সমাজের কৌতূহল দেখতে পাই, তারও মূলে রয়েছে নীতি-কবিতা প্রচলনের ভূমিকা। 

           শিল্পের সংস্থিতি উপেক্ষা করলে মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারে না কোনো কবিতা। আর মানুষের কাছে পৌঁছুতে না পারলে কবিতা রচনা ব্যর্থ। পাঠকের মনে যদি কবিতা কিছু সঞ্চার না করে, তা হলে সে করবেটা কী? বলা হয়ে থাকে, পৌঁছানোর জিনিসটা কেবলই রূপনির্ভর। কিন্তু ভুললে চলবে না, রূপেরও তো একটা ঈপ্সিত ছাপ বা ভাব থাকে, যা কবি এঁকে দিতে চান পাঠককুলের হৃদয়-গভীরে। সেটি কি একরকম বোঝানোর কাজ নয়? ভাবা বা ছাপ যা কবি এঁকে দিতে চান, সেটা অবশ্যি একান্ত কবিরই; পাঠক যদি ঠিক তা ধরতে না পারেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পাঠকরা যদি আকৃষ্ট ও প্রাণিত না হন, তাদের বোধের তলদেশ যদি দুলে না ওঠে চেনা-অচেনা কোনো বোধের তরঙ্গে, তা হলে ওই কবিতা কি ব্যর্থ নয়? এই যে কিছু সঞ্চার করা এবং বোধের তরঙ্গে তলদেশ দুলে ওঠা—এটা সবচেয়ে বেশি হয় নীতি-কবিতায়। হয় কেন? এজাতীয় কবিতায় প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়ের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ হয় বলে, ভাষা ও বর্ণনা ঝরঝরে নির্ভার হয় বলে এবং ছন্দের সুরেলা ঝঙ্কার পাঠকের হৃদয়কে নাচিয়ে তুলে বলে। কবিতার একদল সমালোচক সেই আদিকাল থেকেই বলে আসছেন, কবিতাকে আনন্দ দিতে হবে, আবার উপদেশও দিতে হবে। কবিতা থেকে কোনো একরকম নৈতিক সহায়তা পাওয়া আকাঙ্ক্ষাটা একসময় মানুষের মজ্জাগত ছিল। কিন্তু পরে অন্যায়ভাবে তাকে আপন নিবাস থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ‘কবিতার কাজ হচ্ছে খুলে দেখানো, শেখানো নয়’। কিন্তু কেন? তার কাজ তো একই সঙ্গে খুলে দেখানো এবং শেখানোও। ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ানুভূতি যেমন নিজে উপভোগ করার মতো, তেমনি তা অপরের ভেতর সঞ্চার ও শেয়ার করার মতোও। শুধু সৃষ্টি করলে কী হবে? সরবরাহও তো করতে হবে। কবিমাত্র মানবের মাঝে শাশ্বত জীবনবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। তাঁর বোধ ও ভাবনার রাজ্যে দিবারাত যে সংক্রমণ, তা তিনি চালিয়ে দিতে চান সবার মাঝে। তাই তার ব্যক্তিক অনুভূতি হয়ে ওঠে সবার অনুভূতি। কবিতা কোনোমতেই ধর্ম নয়; আবার ধর্মকথাদীপ্ত কবিতাও অকবিতা নয়। কবিতা যা দিতে পারে, তার কাছে তার চেয়ে বেশি চাওয়াটা ঠিক নয়, আবার যা দিতে পারে, তা ফিরিয়ে দেয়াও যৌক্তিক নয়। কবিতা শুধু মলমের কাজ না, মহৌষধের কাজও করে। কবিতাকে প্রচার করতে হয় না ধর্মতত্ত্ব ও নীতিকথা। কিন্তু এগুলো প্রচার করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। কবিতা মানুষকে সচেতন করে, সজীব করে—এমনকি তাদের আমূল পরিবর্তনও করতে পারে। যেমন পারে ধর্ম ও নীতি। 


            গবেষকরা বলেছেন, বাংলাসাহিত্যে নীতি-কবিতার জন্ম হয় মধ্যযুগে। ওই সময় ভারতজুড়ে নানা পরিবর্তন, আন্দোলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ। মানুষের মূল্যবোধ তখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। চারিত্রিক শুদ্ধচারিতা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। ঠিক ওই সময় নানা নৈতিক উপদেশ ও নীতিকথা কাব্যের আদলে অভিব্যক্ত হয়। তবে তখন নীতি-কবিতার আঙ্গিকরীতি নিয়ে তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি, তাতে তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই মূলত আধুনিক আঙ্গিকে বাংলাসাহিত্যে নীতি-কবিতার ব্যাপক-বিচিত্র প্রকাশ ও প্রসার ঘটেছে। বাংলা নীতি-কবিতা যাদের চর্চায়-পরিচর্যায় ও সচেতন প্রয়াসে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৭-১৯০৭), রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), শেখ ফজলুল করীম (১৮৮২-১৯৩৬), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩), ডা. লুতফর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), শেখ হবিবর রহমান (১৮৯১-১৯৬২), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), কাজী কাদের নেওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কবিদের মধ্যে কেউ কেউ নীতি-কবিতা-রচনার প্রতি এত বেশি ঝুঁকেছিলেন যে, তাদের একাধিক স্বতন্ত্র গ্রন্থ আছে নীতি-কবিতা নিয়ে। যেমন—রজনীকান্ত সেন। তার দু’টি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রয়েছে শুধু নীতি-কবিতা নিয়ে। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত’ আটচল্লিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে এবং ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘সদ্ভাব কুসুম’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাকাব্যের এই ঐতিহ্যধন্য ধারাটি ক্রমনিম্নগামী হয়ে এক সময় হারিয়ে গেছে। খোদাবন্দনা ও রাসুলপ্রশস্তির ধারাটি, যদিও নিভু নিভু অবস্থায় কোনোরকম টিকে আছে। কিন্তু নীতি-কবিতার ধারাটি একেবারে হারিয়ে গেছে বললেও চলে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের পর থেকে নীতি-কবিতা-রচনার প্রয়াস তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। এখন নীতি-কবিতার নিরাপদ আশ্রয় বলতে শুধু কয়েকখানা পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা। সেখানেও আবার কর্তন-বিয়োগের আজব খেলা। সেই শৈশবে যে পড়েছিলাম ‘এই করিনু পণ মোরা/এই করিনু পণ ফুলের মত গড়ব মোরা মোদের এই জীবন’ কিংবা ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’—এগুলো এখন আর দেখা যায় না। অথচ একথা সবাই মানবেন যে, সার্বিক নীতিভ্রষ্ট ও নীতিশূন্যতার এ কালিমাচ্ছন্ন সময়ে নীতি-কবিতারই প্রবল প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যাতে ব্যক্তিতে, সমাজে, বিশেষ করে আমাদের সমাজের তরুণ ও কিশোরদের মাঝে নৈতিকতার নতুন জাগরণ সূচিত হয়। আশার কথা হলো, বিদ্বত্সমাজ এই কবিতাসত্তাকে একেবারে ভুলে যাননি। অন্তত ক্ষুদ্রকায় কিছু সঙ্কলন বের করে হলেও তাকে স্মরণ রেখেছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি ‘বাংলাসাহিত্যের সেরা উপদেশমূলক কবিতা’ নামে একটি সঙ্কলন বের করে ১৯৯০ সালে। সেটির দ্বিতীয় সংস্করণও বের হয় ২০০০ সালে। কিন্তু বাংলাসাহিত্যের নীতি-কবিতার সমাদরপূর্ণ সংখ্যাধিক্যের তুলনায় সঙ্কলনটি খুবই ক্ষুদ্র ও ক্ষীণকায়। মাত্র পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার বইটিতে আটত্রিশজন কবির মোট একশ’ চারটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সেই সঙ্গে ‘বাঙালি-স্বভাব’ সুলভ অযত্ন ও অনুসন্ধিত্সার অভাবও সৃস্পষ্ট। নীতি-কবিতা বা উপদেশমূলক কবিতার সঙ্কলন থেকে গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭১৯৬৪), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯) ও কাজী কাদের নেওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩) কেন বাদ পড়েছেন, সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার। অথচ এখনও গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’, আবদুল কাদিরের ‘মানুষের সেবা’ ও মৈত্রী’, বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের গ্রাম’, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ ও ‘মা’ পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এঁদের আরও একাধিক নীতি-কবিতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁদের কাব্যসম্ভরে। নীতি-কবিতার নানাকৌণিক রূপ-গুণ ও অবদানের ফলে কিছু কিছু কবিতা প্রবাদ-প্রবচন ও কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। সেগুলো এখনও মানুষের জিহ্বায় নেচে ওঠে, দুলিয়ে দেয় হৃদয়ের রুমাল। যেমন ধরা যাক— আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়/লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। চিরসুখী জন/ভ্রমে কি কখন/ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কী যাতনা বিষে/বুঝিবে সে কিসে/কভু আশী বিষে দংশেনি যারে। যে জন দিবসে/মনের হরষে/জ্বালায় মোমের বাতি/আশু গৃহে তার/দেখিবে না আর/নিশিতে প্রদীপ ভাতি। (কৃষ্ণকুমার মজুমদার) পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার। (কালীপ্রসন্ন ঘোষ) আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। (কামিনী রায়) বাবুই হাসিয়া কহে, ‘সন্দেহ কি তায়?/কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়,/পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা/নিজের হাতে গড়া মোর কাঁচাঘর খাসা। (রজনীকান্ত সেন) আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে/মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন/মানুষ হইতে হবে এই তার পণ/বিপদ আসিলে কাছে হয় আগুয়ান/নাহি কি শরীরে তার রক্ত মাংস প্রাণ? (কুসুমকুমারী দাশ) ‘দাঁত আছে বলে কুকুরের গায়ে দংশি কেমন করে/কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়ে পায়,/তা’ বলে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত, মূল শেখ সাদী) গোলাপে ছিঁড়িয়া কেহ কি পেরেছে হাসি তার কেড়ে নিতে?/ধুলায় পড়েও হাসি ফোটে তার পাপড়িতে পাপড়িতে! (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত, মূল, জালালুদ্দীন রুমী)।  Source: Daily Amardesh


2 comments:

  1. বাংলা সব ধরণের গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete