Friday, February 22, 2019

কবি ও সংগীত শিল্পী মুহিব খানের একটি দেশাত্ববোধক ইসলামী গান

(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

এদেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য উঠে
এদেশে আল্লাহু আকবারের সুরে সূর্য ডোবে।।
এদেশে মাল্লা মাঝি, কিষান মজুর সবার ঠোটে
শোনরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জিকির ওঠে।

ঈমানের তপ্ত আগুন জ্বলছে সবার বুকে বুকে
সে আগুন দেশ হতে দেশ দেশান্তরেও জ্বালতে হবে।।
এদেশের পথে ঘাটে এদেশের বাজার হাটে
এদেশের গঞ্জে গ্রামে খোদার নামের তাসবি হাতে
কত পীর আউলিয়াদের অশ্রু ঝরে গভীর রাতে।
যে দেশের সন্তানেরা মক্তবে যায় কোরআন বুকে
সে দেশে আল কোরআনের শাসন কায়েম করতে হবে।।
এদেশের আকাশজুড়ে, আযাদীর নিশান ঊড়ে
এদেশের মিনার হতে মুয়াজ্জিনের আযান শুনে
কোটিপ্রান সিজদা করে খোদার সনে।।
এদেশের জলে স্থলে, এদেশের ফুল ফসলে
এদেশের সবুজ মাটি, সবুজ ঘাসে, সবুজ বনে
মদীনার সবুজ মিনার ঝলসে ওঠে দুই নয়নে।
এদেশের শিকড় তো নয় দিল্লী কিংবা ওয়াশিংটনে
এদেশের শিকড় যেন ছড়িয়ে আছে দূর মদীনায় ।

Wednesday, February 20, 2019

ফেইসবুকে বিবিধ বিষয়ে কবি মাসুদ খানের কিছু পোষ্ট







ডেইজি সামোরা-র একগুচ্ছ কবিতা--

[ডেইজি সামোরা: জন্ম ১৯৫০, মানাগুয়া, নিকারাগুয়া। সমকালীন মধ্য-আমেরিকান কাব্যক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ বুজুর্গদের মধ্যে ডেইজি সামোরা অন্যতম। তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয় এক আপসহীন কণ্ঠস্বর। দৈনন্দিন জীবনের নানা খুঁটিনাটি পুঙ্খে-পুঙ্খে উঠে আসে তাঁর কবিতায়। রাজনীতি থেকে শুরু করে মানবাধিকার, বিপ্লব থেকে শুরু করে নানা নারীবাদী ইস্যু, ইতিহাস থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি-- এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাঁর কবিতা। স্প্যানিশ ভাষায় রচিত বহুলপঠিত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের জননী তিনি। এ ছাড়াও আছে ইংরেজি ভাষায় লেখা বেশ কিছু বই। নারী-অধিকার বিষয়ে সোচ্চার এই কবি সম্পাদনা করেছেন নিকারাগুয়ান নারী কবিদের কাব্যসংকলন। বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সংকলনখানা। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর কবিতা। ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে। ১৯৭০-এর দশকে, সোমোজার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলতে থাকা দীর্ঘদিনের সংগ্রাম যখন ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ও বিস্তৃত হয়ে, তখন ডেইজি জড়িয়ে পড়েন, রীতিমতো নিমজ্জিত হয়ে যান, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। ১৯৭৩-এ যোগ দেন ন্যাশনাল সান্দিনিস্তা লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএসএলএফ-এ। বস্তুত তিনি ছিলেন এনএসএলএফ-এর একজন সক্রিয় যোদ্ধা। সান্দিনিস্তা গেরিলাদের গোপন প্রচারমাধ্যম রেডিও সানদিনো-র ভয়েস ও প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন ১৯৭৯-এ, সান্দিনিস্তাদের সেই চূড়ান্ত ধাক্কা ও অভ্যুত্থানের আগুনঝরা দিনগুলিতে। বিপ্লব চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে তিনি নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন হন্ডুরাস, পানামা ও কোস্টারিকায়। ১৯৭৯-এর জুলাইয়ে বিজয়লাভের পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় কবি সামোরাকে। এর্নেস্তো কার্দেনাল তখন ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁরা দুজনে বেশ কিছুকাল কাজ করেছেন একসাথে।]

//কনিষ্ঠতম সন্তানের কাছে মিনতি//

[তোমাতে করেছি আমি প্রাণের সঞ্চার

তোমাপ্রতি এ-আমার 
নিয়তিবাধিত এক নিদারুণ উপহার
ক্ষমা করে দিয়ো তুমি, সন্তান আমার
--*রুবেন দারিয়ো]

এমন যাতনা নিয়ে করি আমি প্রতীক্ষা তোমার 

যে-যাতনা শুধু বেড়ে যায় দিনে দিনে,
এইরূপ ঊষরতা নিয়ে করি প্রতীক্ষা তোমার 
যা আমার সুখশান্তি করেছে বরবাদ,
বলদের মতো বাঁধা আমি আস্টেপৃষ্ঠে জলযন্ত্রের চাকার সাথে তার-- 
এই কথা জানার যে বিষণ্ণতা, তা-ই নিয়ে করি হে তোমারই ইন্তেজার।

সাহস করি না আর তোমাকে যে শোনাব কূজন,

বোলাতে বোলাতে হাত আমার এ-গর্ভবর্তুলে: যা-কিনা তোমারই ভুবন।
এই যে মৃত্যুবাসনা, এই বক্ষে কেবলই আমার 
জারি রাখে সে-এক অকথ্য অত্যাচার--
মাফ করে দিয়ো তাকে।

আমাকে তুমি দাও সেই দম, সেই শ্বাস, যা তোমাকে

ঠেলে দেবে জীবনের দিকে
বয়ে নিয়ে যাবে দূরে আমার এ-জাহাজডুবো হৃদয়টিকে।

(*রুবেন দারিয়ো-কে বিবেচনা করা হয় নিকারাগুয়ার শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে। আধুনিকতাবাদী ঘরানার অন্যতম উদ্গাতা ছিলেন তিনি। তাঁর কাজ ও লেখালিখি নিবিড় ও গভীরভাবে ইয়াংকি-বিরোধী।)

//একান্ত অনুগত গৃহিনী//

মধুচন্দ্রিমাতেই খতম সবকিছু-- 

কমলাফুলের ফুটে-ওঠা, প্রেমপত্রাবলি,
শিশুতোষ কান্নাকাটি-- সব, সবকিছু।

এইবার হামাগুড়ি দাও তোমার মালিকের পায়ের তলায়,

প্রথমেই তার যে হারেম আছে, সেটার ভেতর,
সেইখানে, তারই মর্জিমাফিক গৃহীতা হবে তুমি, হবে পরিত্যক্তা।

সন্তানের মা তুমি, অথচ সেই সন্তান ধারণ করে আছে

তোমার সে-মনিবের নাম,
ডায়পারের ভারে ন্যুব্জ কাপড়-শুকানো দড়ির পাশে দাঁড়িয়ে 
নিজের নসিব নিয়ে তোমার ওই অস্ফুট বিলাপ,
হৃদয়কে চিপড়ানো, নিংড়ানো...
যতক্ষণ-না তার শোধন হয় তোয়ালে ও বেডশিটে।

শুকনা রুটির দিকে বাড়ানো, অপমানে নোয়ানো একটি হাত

চিৎকার-চেঁচামেচি আর অপমানে-অপমানে ধ্যাতা-ধরা কোণঠাসা এক অবলা গৃহিণী
মাইগ্রেন, শিরাফোলা আর বহুমূত্রে-ভোগা এক চিরবিলাপিনী ছায়ামূর্তি।

শোকেস-সামগ্রীরূপে রাখা একটি তরুণী

যে-কিনা বিবাহ করেছিল তার প্রথম প্রেমিক,
যে-কিনা বুড়িয়ে গেল শুনতে শুনতে জীবনের দূরবর্তী সংগীত 
তার যে কথিত ‘স্ত্রী-মর্যাদা’, সেই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।


//বিলাপ//

আর যদি নাই দেখতে পারি কখনো তোমায়

তাহলে কীসের জন্যে এই চক্ষুদ্বয়?
কেনই-বা এই হাত, সোহাগ বোলায় খাঁ-খাঁ শূন্যতায়, তীব্র ফাঁকাময়তায়?

কেনই-বা জীবন?

//সূর্যকিরণ//

কী যে ঈর্ষা করি! 

আহা, ঘুম না ভাঙিয়ে তোমার
বসেছে কাঁধের ’পরে এসে ওই রবির কিরণ!

সোনালি আলোর ছোঁয়ায় তার

জ্বলজ্বল করছে ত্বকেরা তোমার 
আজ সকালের এই স্যাঁতসেঁতে ছায়ার ভেতর।


//আমি ফের আমি হই আরো একবার//

আমি আর আমার বাচ্চারা যখনই ঢুকি তার বাড়ির ভেতর

আমি ফের আমি হই আরো একবার, 
আহা ফিরে পাই নিজেকে আবার।

রকিং চেয়ারে বসে থেকে 

বুঝে যান এসেছি আমরা, আলতো করে মাথাটা তোলেন।
তেমন আর হয় না আলাপ, যেমনটা হতো আগে।
প্রস্তুত হচ্ছেন তিনি প্রস্থানের জন্যে।

কিন্তু আমি তো আসি তার কোলে মাথাটা ডোবাতে,

বসে থাকতে তার পায়ের নিকট।
নিয়ত বিরাজ করি আমি তার ধ্যানে, ভাবনায়
আমার সে হারিয়ে-আসা বেহেশতখানায়
যেইখানে এই মুখটি আমার হয়ে যায় অন্য এক মুখ,
যেই মুখ ভাসে শুধু তারই চেতনায়
ক্ষণে-ক্ষণে উদ্ধার-করা একটি চেহারা
চির-ঝাপসানো, নীল নিষ্প্রভ ওই চোখের মণিতে,
অন্ধ আঁখিতারায়, যেখানে
খুব হেফাজত করে তুলে রাখেন এ মুখখানি আমার।


//প্রাণী ও তার পোষমনিব//

উদ্যানের প্রাণীর মতো, আমি দেখেছি তাদের...

--এর্নেস্তো মেহলা সানচেজ
রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখি—

একজন লোক, প্রাণীদের পোষ মানায়, পানি দিচ্ছে বাগানে এখন
(চেহারা লুকানো তার ছায়ার আড়ালে)
যথেষ্ট নিরীহ লাগে তাকে: যেন এক গোবেচারা, 
ব্যস্ত শুধু নেহাত মামুলি কিছু কাজে, 
ব্যস্ত কিছু বিবর্ণ গোলাপ আর রুপালি গুল্মের দেখভালে।

পাতাদের একঝলক শিহরন

এই মর্মে জানান দিয়ে যায়, যে, হাওয়া বইছে হঠাৎ
আর পরিপৃক্ত ওই উঠান থেকে উঠে এসে হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়, 
ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে আমার,
ঝাপটে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার এ ভাঁজ-পড়া 
কোচকানো হৃদয়ের যত বিশুষ্ক বলিরেখা।


//তোমার উৎকর্ষ//

সে-এক অননুকরণীয় উৎকর্ষ তোমার
লুক্সরের মন্দিরের মতন, যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি, সেই

মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামে: 
চুনসুরকিহীন, পাথরের ওপর শুধু পাথর বসিয়ে বানানো।
(ব্যাপারটা দেখিয়ে দিলেন জাদুঘরের গাইড মশায়)
নিউ ইয়র্কীয় আকাশের উঁচু ধূসর গম্বুজের
নিচে শানদার একটি মন্দির।

এই এত যে উৎকর্ষ, আর এত যে মহিমা, 

তার চেয়েও বেশি পছন্দ আমার
গোধূলিকালীন হাত দুটিকে তোমার।


//চূড়ান্ত অবধি//

হৃদয় আমার

লড়ে যায় হরদম: 
নাই এমন কোনো ব্যূহ, যাকে সে ভেঙেচুরে ভেদ করে পারে না যেতে;
শহিদ হয়ে যায় আমার এ-প্রাণ আমাদের ভূখণ্ড-রক্ষায়।


Masud Khan August 29, 2018(সর্বশেষ পোষ্ট ডেইট)(Facebook)

আট বছর আগের একদিন – জীবনানন্দ দাশ


শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম—অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই-মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়—অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালবেসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন—যেন কোন্‌ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার করে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলে নি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’
জানায় নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য রোধ হল;
মর্গে—গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!
শোনো তবু এ মৃতের গল্প;—কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্‌বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু – আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থে নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পালটায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!—
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার -’
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হব—বুড়ি চাঁদটারে আমি
করে দেব কালীদহে বেনো জলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্যে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

Monday, February 18, 2019

মানুষের সেবা - আবদুল কাদির

- আবদুল কাদির


হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান 
তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান। 
মানুষ বলিবে - তুমি প্রভু করতার, 
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার? 
বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে, 
তারি শুশ্রূষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে। 
খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান, 
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান। 
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু, 
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু? 
বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে, 
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে। 
পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান, 
পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি জল পান। 
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী, 
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি? 
বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে, 
তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।

Friday, February 15, 2019

রসাল ও স্বর্ণলতিকা - - মাইকেল মধুসূদন দত্ত


- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!
ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।
-সমাপ্ত-

নবীর শিক্ষা - শেখ হাবিবুর রহমান

- শেখ হাবিবুর রহমান


তিন দিন হ'তে খাইতে না পাই, নাই কিছু মোরে ঘরে, 
দারা পরিবার বাড়িতে আমার উপোস করিয়া মরে। 
নাহি পাই কাজ তাই ত্যাজি লাজ বেড়াই ভিক্ষা করি, 
হে দয়াল নবী, দাও কিছু মোরে নহিলে পরাণে মরি।' 
আরবের নবী, করুণার ছবি ভিখারির পানে চাহি, 
কোমল কণ্ঠে কহিল, -'তোমার ঘরে কি কিছুই নাহি?' 
বলিল সে, 'আছে শুধু মোর কম্বল একখানি।' 
কহিল রসুল, 'এক্ষণি গিয়া দাও তাহা মোরে আনি।' 
সম্বল তার কম্বলখানি বেচিয়া তাহার করে, 
অর্ধেক দাম দিলেন রসুল খাদ্য কেনার তরে, 
বাকি টাকা দিয়া কিনিয়া কুঠার, হাতল লাগায়ে নিজে, 
কহিলেন, 'যাও কাঠ কেটে খাও, দেখ খোদা করে কি-যে।' 
সেদিন হইতে শ্রম সাধনায় ঢালিল ভিখারি প্রাণ, 
বনের কাষ্ঠ বাজারে বেচিয়া দিন করে গুজরান। 
অভাব তাহার রহিল না আর, হইল সে সুখী ভবে, 
নবীর শিক্ষা ক'রো না ভিক্ষা, মেহনত কর সবে। 

ষোলা আনাই মিছে - সুকুমার রায়

বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে, 
মাঝিরে কন, ''বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে? 
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?'' 
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্‌ফেলিয়ে হাসে। 
বাবু বলেন, ''সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি, 
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।'' 

খানিক বাদে কহেন বাবু, ''বলতো দেখি ভেবে 
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে? 
বলতো কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?'' 
মাঝি সে কয়, ''আরে মশাই অত কি আর জানি?'' 
বাবু বলেন, ''এই বয়সে জানিসনেও তা কি 
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!'' 

আবার ভেবে কহেন বাবু, '' বলতো ওরে বুড়ো, 
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো? 
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?'' 
বৃদ্ধ বলে, ''আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?'' 
বাবু বলেন, ''বলব কি আর বলব তোরে কি তা,- 
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।'' 

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে, 
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে! 
মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি, 
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?'' 
মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু 
মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু? 
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, 
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!'' 
Please See this video:

Thursday, February 14, 2019

পাছে লোকে কিছু বলে - কামিনী রায়

- কামিনী রায়

করিতে পারি না কাজ 
সদা ভয় সদা লাজ 
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,- 
পাছে লোকে কিছু বলে। 
আড়ালে আড়ালে থাকি 
নীরবে আপনা ঢাকি, 
সম্মুখে চরণ নাহি চলে 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

হৃদয়ে বুদবুদ মত 
উঠে চিন্তা শুভ্র কত, 
মিশে যায় হৃদয়ের তলে, 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি 
সযতনে শুকায়ে রাখি;- 
নিরমল নয়নের জলে, 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

একটি স্নেহের কথা 
প্রশমিতে পারে ব্যথা,- 
চলে যাই উপেক্ষার ছলে, 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

মহৎ উদ্দেশ্য যবে, 
এক সাথে মিলে সবে, 
পারি না মিলিতে সেই দলে, 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

বিধাতা দেছেন প্রাণ 
থাকি সদা ম্রিয়মাণ; 
শক্তি মরে ভীতির কবলে, 
পাছে লোকে কিছু বলে। 

Tuesday, February 12, 2019

গদ্য কবিতার ছন্দ - শেখ জলিল



   বাংলা কবিতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যুগে যুগে এর বিষয় আঙ্গিক,ছন্দেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সেই যে চর্যাপদ থেকে যার যাত্রা শুরু তা এখন ঠেকেছে অতি আধুনিকতায়। আর এ আধুনিক কবিতার মূল বিবর্তন এসে স্থিত হয়েছে গদ্যছন্দে। তাইতো গদ্যছন্দেই লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন আধুনিক কবিরা।


   আসলে গদ্য কবিতাই বা কী গদ্যছন্দই বা কীএককালে আমরা ছন্দোবদ্ধ অন্তমিলযুক্ত বর্ণনাকে পদ্য বলে জেনেছি। কিন্তু বর্তমানে কবিতার বিশালতায় এর ছন্দঅন্তমিলউপমাচিত্রকল্প কিংবা শারীরিক গঠনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। স্বরবৃত্ত্মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কতো বিচিত্রপ্রয়োগই না করছেন আধুনিক কবিরা। অক্ষরবৃত্তের পয়ার থেকে চতুর্দশপদীঅমিত্রাক্ষরমুক্তক ছন্দের যে বিবর্তনসে বিবর্তনের ধারায়ই এসেছে গদ্যছন্দ।

   গদ্যকবিতা বা গদ্যছন্দের শুরু হয় রবীন্দ্র যুগেই। রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে যে ক'জন সমাজতন্ত্রী কবি গদ্যছন্দের প্রবর্তন করেন তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-ই সবচেয়ে সফল। অবশ্য এর মধ্যেই বিষ্ণু দে প্রবর্তিত এক ধরনের গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মূলত ত্রিশের দশকের কবিদের হাতেই ঘটে গদ্যছন্দের ব্যবহার।

   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশ প্রথম প্রথম এর বিপক্ষে ছিলেন। প্রতিবাদস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত একটি পত্রিকায় গদ্যছন্দের কবিতা প্রকাশ বন্ধ রাখেন। কাজী নজরুল ইসলামতো ব্যঙ্গ করে একটি কবিতাই লিখে ফেলেন। অথচ জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথ একে অনুমোদন দিয়ে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের হাতেও ঘটেছে কবিতায় গদ্যরীতির সাধুবাদ। রবীন্দ্রনাথের 'রূপনারানের কূলে জাগিয়া উঠিলাম', নজরুলের 'লাথি মারভাঙরে তালাকিংবা জীবনানন্দের 'যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারাবাংলা কবিতায় গদ্যরীতির সফল প্রয়োগ। বিশ্বকবির 'হঠা দেখাবা বিদ্রোহী কবির 'আমার কৈফিয়তকৃষ্ট সুন্দর গদ্যকবিতা।

   যা বলছিলাম ত্রিশের কবিদের কথা- বিষ্ণু দে সুধীন্দ্রনাথ দত্তবুদ্ধদেব বসু সবাই ছিলেন গদ্যকবিতার অগ্রযাত্রী। এর মধ্যে সুধীন্দ্রনাথের গদ্যরীতিইকবিতায় সফলতা এনেছে। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের দু'জন কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং শহীদ কাদরী কবিতায় গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে শহীদ কাদরীর গদ্যরীতি সবচেয়ে সফলআটসাঁট এবং উল্লেখযোগ্য।

   গদ্যকবিতার ছন্দ বা গদ্যছন্দ আসলে কী নতুন কবিরা যখন আধুনিক কবিতা পড়েন তখন এর অন্তর্নিহিত ছন্দ খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খান। অনেকে গদ্যকবিতাকে ছন্দহীন কবিতা ভাবতে থাকেন। কিন্তু গদ্যকবিতার ইতিহাস অনেক বিশাল। শুরুতেই বলেছিলাম পয়ার থেকে এর যাত্রা শুরু। অক্ষরবৃত্তের মুক্তক ছন্দে এসে এর নতুন বিবর্তন হয়েছে গদ্যছন্দে। তাই গদ্যছন্দের মূল স্বাদ আস্বাদনে সব কবিকেই চষতে হয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিশাল জমিন।

   গদ্যকবিতার রীতি একেক কবির কাছে একেক রকম। আধুনিক যে কবিরা গদ্যছন্দে সফলতা পেয়েছেন তারা সবাই প্রথম অক্ষরবৃত্তে লিখে হাত পাকিয়েছিলেন। আর তার ফলশ্রুতিতে তারা পেয়েছেন কবিতায় তাদের নিজস্ব গদ্যরীতি। হাসান হাফিজুর রহমানশহীদ কাদরী ছাড়াও শামসুর রাহমানআল মাহমুদসৈয়দ শামসুল হকআবু জাফর ওবায়দুল্লাহসাইয়িদ আতিকুল্লাহ প্রমুখ কবি গদ্যকবিতার অন্যতম পথিকৃত। ষাট ও সত্তর দশকের আবুল হাসানরুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আবিদ আজাদ ছিলেন বেশ সফল।

   কেউ বলেন উপমাই কবিতা। কেউ বলেন চিত্রকল্পকেউ বলেন অতীন্দ্রিক ভাবনাআবার কেউ বলেন বাস্তবের সাথে কল্পনার সংমিশ্রণ। আবার নতুন করে কাউকে কাউকে বলতে শুনি- যা গদ্য নয় তাই কবিতা। এ কথার সাথে অবশ্য ছড়াপদ্য বা লিরিকের একটা দ্বন্দ চলে আসে তখন। আসলে কবিতা অনেক বিমূর্তঅনেক ভাবনাবহুল। গদ্যকবিতার বা গদ্যছন্দের কথা বলতে গিয়ে কবিগবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন নাচের আসরের নর্তকীর দেহের অস্থি-মজ্জার কথা। আমি বলবো প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের কথা। প্রত্যেক মানুষই হাঁটে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। এ হাঁটা তার একান্তই নিজের। এ চলায়ও আছে তার নিজস্ব স্টেপ বা পদক্ষেপ এবংচলার নির্দিষ্ট দূরত্ব বা তাল। এ তাল- চলনই হলো একজন কবিতা লেখায় তার গদ্যরীতি। সুন্দর হাঁটা যেমন ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলেসুন্দর গদ্যরীতিও তাই। আর চলতে চলতে যদি ক্লান্তি আসে হঠা-ই থেমে পড়তে হয়- তবে চলারও যেমন ছন্দপতন হয়কবিতায়ও তেমনি। আসলে পাঠককে ধরে রাখাই গদ্যকবিতার মূল বৈশিষ্ট্য। পড়তে পড়তে পাঠক যাতে ক্লান্ত না হয় সেদিকে খেয়াল করলেই কবিতার গদ্যছন্দে আসবে কবির স্বার্থকতা।

১৩.০৬.২০০৬ 

শিক্ষকের মর্যাদা - কাজী কাদের নেওয়াজ

বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর। 
একদা প্রভাতে গিয়া 
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া 
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে 
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে, 
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি 
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি। 
শিক্ষক মৌলভী 
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি। 
দিল্লীপতির পুত্রের করে 
লইয়াছে পানি চরণের পরে, 
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে! 
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে। 
হঠাৎ কি ভাবি উঠি 
কহিলেন, আমি ভয় করি না'ক, যায় যাবে শির টুটি, 
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার 
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার, 
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল, 
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল। 
যায় যাবে প্রাণ তাহে, 
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে। 

তার পরদিন প্রাতে 
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে। 
খাস কামরাতে যবে 
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে, 
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে? 
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা, 
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা'' 
শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়, 
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?'' 
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে 
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন, 
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ। 
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে 
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।'' 

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে 
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে- 
''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, 
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।'' 


Please See this video:

অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গান -এটি কি 2441139? এর জবাবে বেলা বোস


পানি চক্র -মেহেদী হাসান


উৎস:  কিশোর বিজ্ঞান সাময়িকী - ব্যাপন, www.byapon.com

গানের কবিতা: তুমি শাজাহান নও আমার জন্যে বানাবে তাজমহল - আবিদ আনোয়ার



Sunday, February 10, 2019

প্রাচীন পুঁথি: উৎসমুখের খোঁজে



তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

পুঁথি-সাহিত্য আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এমন এক সময় ছিল যখন ঘরে ঘরে ছিল পুঁথি। দিনের আলো নিভে গেলেই কুপি জ্বালিয়ে শুরু হত পুঁথি-পাঠ। পুঁথি-পাঠককে ঘিরে সকলেই জড়ো হতেন এবং মনোযোগ সহকারে শুনতেন। প্রাচীনকালে মূলত প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরাই ছিল পুঁথি অনুরাগী। তাদের লেখাপড়া বা ভাবনা-চিন্তার পরিধি আটপৌরে হলেও অন্যরা যে একে অবহেলা করতো, তা কিন্তু নয়। সেকালে পুঁথি ছিল সার্বজনীন। শিশু-কিশোর-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলের কাছেই পুঁথি-সাহিত্যের অনুপম কাহিনী-আখ্যানগুলো ছিল অমৃততুল্য। আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার দাপুটে বাস্তবতায় প্রাচীন পুঁথিকাব্য, পুঁথি-কাহিনী বিস্মৃত ও বিলুপ্ত প্রায় হলেও আজো মানুষ ফিরে যেতে চায় স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলের সেই বিমূর্ত নান্দনিক স্টেশনে, যেখানে পুঁথি সাহিত্যের মিথ কল্পকথা, লোক কাহিনী, লোকাচার, ধর্মকথা, রাজবন্দনা, হাসিকান্না, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের রূপচ্ছটায় বিরাজ করে অলৌকিক আনন্দ ভুবন।
প্রাচীনকালে যখন ছাপাখানা ছিল না তখনো প্রচলন ছিল পুঁথির। এ উপমহাদেশে ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে কাগজ ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। (ওহফরধহ চধষবড়মৎধঢ়যু- ইঁযষবৎ, ১৯৬২, চধমব-১৪৫) । আর ১৭৭৮ সালের পূর্বে বাংলাভাষার কোন ছাপাখানাও এ তল্লাটে ছিল না। ১৭৭৮ সালে হুগলিতে প্রথম বাংলা ছাপাখানা স্থাপিত হয়। তবে এতদঞ্চলে এয়োদশ শতকের পূর্বে কাগজ ব্যবহারের নমুনা বা ১৭৭৮ সালের পূর্বে ছাপানো পা-ুলিপি আবিষ্কৃত না হলেও অন্যান্য উপাদানে যে লিখন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথিগুলো সাধারণত ভূর্জছাল, কাপড়ের পট, তালপাতায় লেখা হত। তালপাতার পুঁথিগুলোর বেশীর ভাগই ছিল পুজোর পুঁথি। মাদুলির মন্ত্রগুলো লেখা হতো ভূর্জছালে। মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ভিত্তিক বিভিন্ন পুঁথিও লিখিত হতো তালপাতায়। তেরেট নামে তাল জাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের পাতায়ও তখন পুঁথি লেখা হতো। ‘কবি মুকুন্দ রামের বাসভূমি দামুন্যায় তেরেট পাতায় লেখা ‘চ-ী-মঙ্গলের’ একটি পুঁথি সংরক্ষিত আছে’। (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস- প্রথম খ--সুকুমার সেন। চতুর্থ সংস্করণ-১৯৬৩। কোলকাতা। পৃঃ ৫১৪)। তবে ‘হরিতালী কাগজ’ নামে পরিচিত তুলট কাগজে লেখা পুঁথি তখন ব্যাপক সমাদৃত ছিল। কাব্য-সাহিত্য-ধর্মী পুঁথিগুলো এ ধরনের তুলট কাগজে লেখা হতো। এ কাগজ যত মজবুত হতো, লেখাও তত সুন্দর দেখাত। ছাপাখানার ব্যাপক প্রসারের ফলে ঊনবিংশ শতকে পুঁথি-সাহিত্যের নব উন্মেষ ঘটে। এ সময় থেকে হস্তলিখিত পা-ুলিপি বা পুঁথির ব্যবহার ক্রমে লোপ পেতে থাকে এবং এর জায়গা দখল করে নেয় মুদ্রিত পুঁথি। এসময় কোলকাতার শোভাবাজার কেন্দ্রিক বিশেষ ধরনের পুঁথি বা বটতলার পুঁথির প্রচলনের ফলে ‘পুঁথি’ শব্দটি বিভ্রান্তির শিকার হয়।
পুঁথি সাধারণত দু’ধরনের-১) কবির হস্তলিখিত মূল রচনা (ঙৎরমরহধষ গধহঁংপৎরঢ়ঃ) ও ২) লিপিকারের অনুলিপি (ঈড়ঢ়রবফ গধহঁংপৎরঢ়ঃ) । প্রথম ধরনের পুঁথি এখন আর পাওয়া যায় না। লিপিকারের অনুলিপি নিয়েই আমাদের পুঁথির জগৎ- যা থেকে বটতলার পুঁথি বা ছাপানো পুঁথির উদ্ভব। পুঁথির বিষয়বস্তু নানা ধরনের হতে পারে-যেমন কাব্যসাহিত্য, চরিতকাব্য, মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ সাহিত্য, ধর্মকথা, জঙ্গনামা, নবী কাহিনী, দেব-দেবী-পীর আউলিয়া বন্দনা, তন্ত্রমন্ত্র, পূজাবিধি, রাজবন্দনা, পাঁচালি, পদাবলী ইত্যাদি।
বলা হয়ে থাকে, ‘পুঁথি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পুস্তক’ থেকে। তবে প্রাকৃত ‘পুত্থিয়া’, হিন্দি ‘পোথী’, অসমীয়া ‘পুথী’, ফরাসী ‘পুস্তিন’ও যে বাংলা ‘পুঁথি’ বা ‘পুঁথি’ শব্দের প্রচলনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেনি তা বলা যাবে না। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি যদিও লিখিত সাহিত্য, তথাপি এর প্রস্তুতিকর্মের প্রতিটি পর্যায়ে লোকায়ত উদ্যোগ দৃষ্টিগ্রাহ্য হতো। পুঁথির ভেতরের প্রতিটি পাতা চারদিকে মার্জিন রেখে সাজানো হতো, যাতে পৃষ্ঠা ওল্টানো মাত্রই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়। পাতায় কোন লাইন না টেনে সমান্তরালভাবে প্রতি পাতায় সম-সংখ্যক ছত্র সন্নিবেশ করে নিপুণ পটুয়ার মতো পুঁথি যেভাবে লিপিবদ্ধ হতো, তা আজো আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে। প্রাচীন পুঁথিতে উভয় পৃষ্ঠায় লেখার রেওয়াজ ছিল। তবে কাগজ খুব পাতলা হলে উভয় পৃষ্ঠায় না লিখে কাগজ দুভাঁজ করে উভয় পাশে লিখা হতো। পুঁথির পত্রাঙ্ক প্রতি পৃষ্ঠায় না লিখে সাধারণত পাতার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা হত। আবার এমন পুঁথিও দেখা গেছে, যেগুলোতে লিপিকার পত্রাঙ্ক নির্দেশ করত না। পুঁথির দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, অলঙ্করণ, ভুল-ত্রুটি সংশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা চিহ্নের প্রয়োগ হত। প্রাচীন পুঁথির পাতাগুলো ধারাবাহিকভাবে একের এক সাজানো, আলগা ও সেলাইবিহীন ছিল বিধায়, সেগুলোকে কাঠের পাটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হত। এক্ষেত্রে শাল বা সেগুন কাঠের পাটা ব্যবহত হত। এছাড়া কোন কোন পুঁথির বহিরাবরণ হিসেবে চামড়ার খোলের ব্যবহারও চোখে পড়ত। এসব কাঠের পাটা বা চামড়ার আবরণে বাইরের দিকে পুঁথির বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত নানা নকশা বা চিত্র খোদাই বা অঙ্কিত করা হতো। ভেতরের দিকে থাকতো নানা লতা-পাতার চিত্র। ধারণা করা হয়, সতের শতকের লোক-শিল্পের প্রভাব এসব চিত্রে পরিস্ফুট। (অ এবহবৎধষ এঁরফব ঃড় উধপপধ গঁংবঁস, উযধশধ, ১৯৬৪ চধমব-৪৮) ।
প্রাচীনকালে লিখিত বাংলা পুঁথিগুলোর বেশীর ভাগই ছিল বাংলা হরফে। তবে কিছু কিছু বাংলা পুঁথি আরবী হরফেও লিখিত পাওয়া গেছে। যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ গ্রন্থে এ ধরনের আরবী হরফে লিখিত বাংলা পুঁথির নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়। (বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয় (১ম খ-)-যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য। ১৯৭৮ইং। পৃষ্ঠা-৩৮১।) উড়িষ্যা রাজ প্রদর্শনশালা ‘ভুবনেশ্বরে’ ওড়িয়া অক্ষরে অনেক বাংলা পুঁথি সংরক্ষণ করা আছে (প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-৩৮১)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সংগ্রহে বাংলা অক্ষরে একটি উর্দু পুঁথির নমুনা পাওয়া গেছে। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুঁথি-ক্রমিক-৫৮, পৃঃ ১৭৯, পত্র -৯১-১১৫)। কাইথি লিপিতে লেখা ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ এর দুটি কপি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পুঁথিশালায় সংগৃহীত আছে। আঠারো-উনিশ শতকে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিকশিত ‘নাগরী লিপিতে’ প্রচুর পুঁথি লিখিত হয়েছে। নাগরী লিপিতে পুঁথি লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-শীতালং শাহ্, আরকুম শাহ্, শাহনুর শাহ্, ইরফান আলী, ভেলা শাহ্, মুহাম্মদ খলিল, আবদুল কাদির শাহ্, ওয়াহেদ আলী শাহ্, আছদ আলী, মুন্সী সাদেক আলী, মুন্সী আবদুল করিম, ছৈয়দুর রহমান, শাহ আরমান আলী, দীন ভবানন্দ প্রমুখ।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন হচ্ছে পুঁথি। একারণে সুদূর অতীত থেকেই পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা দৃষ্ট হয়। এদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম পুঁথি সংগ্রহে হাত দেন কয়েকজন বৃটিশ নাগরিক। তাদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণের আদি রচয়িতা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) অন্যতম। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১২টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, যা পরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেন। এর মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, চ-ীমঙ্গল ও কালিকামঙ্গল উল্লেখযোগ্য। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বাংলা হরফ নির্মাতা চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৬ সালের দিকে ‘চ-ীমঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ নামে দুটি পুঁথি সংগ্রহ করে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রদান করেন। বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিচার্ড জনসন ১৮০৭ সালে এদেশ থেকে সংগৃহীত ১৪টি বাংলা পুঁথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রদান করেন। তার পুঁথিগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশীরাম দাশের ‘মহাভারত’ লোচন দাশের ‘দুল্লভসার’ ‘চৈতন্যতত্ত্বসার’ ও ‘নামসংকীর্ত্তন’। ১৭৯৩ সালের নভেম্বর বঙ্গদেশে আসেন উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪)। তাঁর নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগার (কেরী লাইব্রেরী) এ খ্রীষ্টান মিশনারীগণ ৩ হাজারেরও বেশী বই ও হস্তলিখিত পুঁথি দান করেন। সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯২১ সালে সংগৃহীত পুস্তক তালিকায় আমরা ৫১টি বাংলা পুঁথির নাম পাই। (বাংলার নব জাগরণে উইলিয়াম কেরী ও তার পরিজন-সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭৪ইং, পৃঃ ১৬৭)। সে সংগ্রহে ছিল ‘মনসার ভাসান’, ‘চ-ী’, ‘জৈমুনী ভারত’, ‘চৈতন্য মঙ্গল’, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ পুঁথি। এদেশে সরকারী প্রচেষ্টায় ১৯৬৮ সালে প্রথম পুঁথি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি। বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল লর্ড লরেন্সের অনুদানকৃত ৩২০০/- টাকা দিয়ে শুরু করা এ কাজে প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয় পুরাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্র লাল মিত্র ও পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে। রাজেন্দ্র এ কাজে ততটা সফল না হলেও হরপ্রশাদ শাস্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেক দুষ্প্রাপ্য বাংলা পুঁথি সংগৃহীত হয়। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত এশিয়াটিক সোসাইটির ‘পুঁথি বিবরণী’তে এ ধরনের ৩৬৭টি পুঁথির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। নগেন্দ্র নাথ বসু প্রায় ৩০০০ (তিন হাজার), সনৎকুমার বসু ২০০০ (দুই হাজার) এবং হরিদাস পালিত অনেক পুঁথি সংগ্রহ করে ‘কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালায় দান করলেও এসবের মধ্যে বাংলা পুঁথির সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য। তবে মনীন্দ্র মোহন বসু সম্পাদিত ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংগৃহীত পুঁথি তালিকায়’ (১ম ও ২য় খ-, ১৯৪১ ও ১৯৬৩) মোট ৫৯২৭টি বাংলা পুঁথির বিবরণ আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বভারতী’ বিভিন্ন ভাষার পুঁথি সংগ্রহের কাজ করে। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের এক হিসাবে দেখা যায়, এ সময় পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে ১৪৩৯টি বাংলা পুঁথি ছিল্ চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ আজীবন পুঁথি সংগ্রহ করেন। তিনি প্রায় সহস্রাধিক পুঁথি আবিষ্কার করেছেন এবং এসব পুঁথি অসাধারণ দক্ষতার সাথে সম্পাদনা করেছেন। তার আবিষ্কৃত পুঁথি নিয়ে তিনি প্রায় ৬ শতাধিক প্রবন্ধ লিখে প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করেন। তার সংগৃহীত পুঁথির মধ্যে আছে আবদুন নবীর ‘আমীর হামজা’ (রচনা-১৮৫৯) শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ (রচনা-১৭৩২), সৈয়দ সুলতানের ‘ওফাত-ই-রসুল’ (লিপিকাল-১৮৩৯), মোহাম্মদ খানের ‘কেয়ামত নামা’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ (১৭৭৭), আলী রেজা ওরফে কানু ফকিরের ‘জ্ঞান সাগর’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (লিপিকাল-১৮৭৮), মোহাম্মদ খানের ‘মুক্তল হোসেন’ (লিপি-১৭৭৪), মোহাম্মদ হানিফার লড়াই (১৭২৪), দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী মজনু’ (১৮২৯), দৌলত কাজীর ‘সতীময়না-লোর চন্দ্রানী’, (লিপি-১৭৫৪), ফকির গরীবুল্লাহর ‘সোনাভান’ ইত্যাদি। তার সংগৃহীত ৫৮৫টি মুসলিম বাংলা পুঁথি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন। তার সংগৃহীত ৩৩৮টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষক ড. এনামুল হক গবেষণার প্রয়োজনে কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত ২৩টি বাংলা পুঁথি বরেন্দ্র রিসার্চ যাদুঘরে আছে। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা শরৎ কুমার রায় সংগৃহীত ১১১০টি পুঁথিও এ মিউজিয়াম গ্রন্থাগারে রয়েছে। অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের সংগ্রহে কিছু পুঁথি ছিল।্ চট্টগ্রামে ইসহাক চৌধুরীর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও অনেক পুঁথি রয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও অনেক পুঁথির সংগ্রহ আছে। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘পরিষৎ পরিচয়’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এ সময় পরিষদ পুঁথিশালায় সংরক্ষিত বাংলা পুঁথির সংখ্যা ছিল ৩২৪৬টি(পরিষৎ পরিচয়- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩৫৬। পৃঃ-৩০)। শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদে ৪৭৯টি বাংলা পুঁথি সংগৃহীত ছিল বলে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য প্রকাশিত একটি তালিকা থেকে জানা যায়। (বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয় (১ম খ-)- অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য, এশিয়াটিক সোসাইটি, কোলকাতা, ১৯৭৮)। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পুঁথি সংগ্রহ সমিতি’ গঠিত হলে ঢাকা যাদুুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টাশালীকে এর সম্পাদক নিয়োগ করা হয়। তার নেতৃত্বে প্রায় ১৭,০০০ বাংলা ও সংস্কৃত পুঁথি সংগৃহীত হয়। এর কিছু পুঁথি বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক পুঁথি সংরক্ষিত আছে। বাংলা একাডেমীও কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩৪৪১টি।
প্রাচীন পুঁথি ভূর্জপত্র, তালপাতা, তেরেট পাতা, হরিতালী কাগজ ইত্যাদি ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী উপাদানে লেখা হতো বলে স্যাঁতসেঁতে বিরুপ আবহাওয়ায় তা নষ্ট হয়ে যেত। তা সত্ত্বে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে সব পুঁথি আজো টিকে আছে তা আমাদের বাংলা সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ। প্রাচীন পুঁথি তা খ-িত, পূর্ণাঙ্গ কিংবা একটি মাত্র পাতা- যাই হোক না কেন এর ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় ঐতিহ্য। ‘চর্যাপদ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ এর কথা আমরা কে না জানি! অথচ এ দুটি পুঁথিও খ-িত ও বিচ্ছিন্ন। আর এগুলো আবিষ্কারের পরই আমাদের নজরে আসে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেক অনাহরিত অধ্যয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে ৪৬টি চর্যাপদ তথা বৌদ্ধ গান ও দোহা উদ্ধার করেন, যা বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দুর্বোধ্য হলেও এগুলো যে বাংলা গীতিকাব্য তথা বাংলা পুঁথির আদিরূপ- তাতে সন্দেহ নেই। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের পুঁথি উদ্ধারের ফলে মধ্যযুগের কীর্তনধারার সুস্পষ্ট রূপ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।’ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর একমাত্র পুঁথিটি কোলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুঁথিশালায়’ সংরক্ষিত আছে।
আনুমানিক পঞ্চদশ শতকে লিখিত এই পুঁথিটি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নির্দশন। দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বস্থানীয় ‘পুঁথি’। মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বলেন, ‘নর-নারীর প্রণয়কে উপলক্ষ করে মধ্যযুগে যে আখ্যায়িকা-কাব্য গড়ে উঠেছিল, তাকে ‘রোমান্স কাহিনী কাব্য’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ এই ধারারই শ্রেষ্ঠ কাব্য’ (সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী-সম্পাদনায়-মযহারুল ইসলাম ও মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ। নওরোজ কিতাবিস্থান, ঢাকা-১৯৭৩, পৃঃ-৩৬) আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ সম্পর্কে ক্ষেত্রগুপ্ত বলেন, ‘পদ্মাবতী কাব্যকে মাঝে মাঝে মাধ্যযুগের বাংলা কাব্যের বাতায়ন নামে চিহ্নিত করার বাসনা জাগে, (প্রাচীন কাব্য সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নব মূল্যায়ন- ক্ষেত্র গুপ্ত।
পুস্তক বিপণি, কোলকাতা। পৃঃ-১৭৮)। এ ধরনের অসংখ্য পুঁথি আজো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদেশের পথে-প্রান্তরে। অতীত বর্তমানের সেতু-বন্ধনের প্রয়োজনে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসমুখের খোঁজে, আমাদের শিকড়ের সন্ধানে ধূলিমলিন আস্তরণ থেকে এসব খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এসব পুঁথির সংরক্ষণ, আরো পুঁথি সংগ্রহ এবং পুঁথির ব্যাপক চর্চা ও গবেষণা প্রয়োজন।