হা সা ন শা ন্ত নু

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি আবুল হোসেন। বাঙালি মুসলমানের আধুনিক সাহিত্যের ‘সপ্তরথী’র প্রথম পুরুষ তিনি। আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ—এ সাতজনকে ‘সপ্তরথী’ বলা হয়। বাঙালি মুসলমানদের জন্য আলাদা সংস্কৃতি, শিল্প আবুল হোসেনের একান্ত কাম্য ছিল। তবে চূড়ান্ত ও মৌলিক অর্থে তিনি সমাজ শিল্পের সামগ্রিক উত্তরণ কামনা করেছেন, বাঙালি মুসলমান সমাজের অবরুদ্ধ জীবন-চেতনার উত্তরণ কামনায় নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর সমকালের কবিদের মধ্যে কেউ কেউ নতুনকে বরণ করে নেয়ার বদলে অতীত আঁকড়ে থাকার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আর তিনি বলেছেন জাগরণ, সমুন্নয়নের কথা। তাঁর দৃঢ়তম উচ্চারণ—‘হে কূর্ম তোমার অন্ধকার, বর্মের গোপন গুহা থেকে, বের হয়ে এসো আজ নির্ভয়ে, এখনও ছিন্ন করো শতাব্দীর কুয়াশায় ঘন, ভ্রান্তির তিমির…।’ নতুন চেতনা, সময় দরকার বাঙালি মুসলমানের শিল্প ও জীবনে—এসব দিক চল্লিশের দশকে মাত্র কয়েক কবি অনুধাবন করেন। সে জন্যই মুসলমান কবিদের আধুনিক কবিতা বিষয় ও রীতি নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষার অব্যাহত একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। ওই কবিদের মধ্যে আবুল হোসেন নিঃসন্দেহে অন্যতম। ‘নবযুগ’ কবিতায় তিনি বলেছেন, মুসলমানদের দিনবদল হচ্ছে। এ কবিতা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ত্রিশের দশকের মাঝামাঝিতে প্রথম প্রকাশিত হয়।
আবুল হোসেন ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। ওই সাহিত্য সমিতির মাসিক সভায় একাধিকবার তিনি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় আয়োজিত এক সাহিত্য সভায় তিনি ‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সাধনা’ শিরোনামের এক প্রবন্ধ পড়েন। তাঁর এ প্রবন্ধ মুসলমান কবি-লেখকদের তখন নতুনভাবে ভাবিয়ে তোলে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটি সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয় কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে। প্রখাত সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ওই মননশীল সভার সভাপতি। সভায় আবুল হোসেন ‘আমাদের মননশীল সাহিত্য’ শিরোনামে প্রবন্ধ পড়েন। ওই প্রবন্ধও বাঙালি মুসলমান কবি-লেখকদের আলোড়িত, ভাবিত করে। প্রবন্ধটি কাজী মোতাহার হোসেন এত পছন্দ করেন যে, পড়া শেষ করতেই তিনি আবুল হোসেনকে জড়িয়ে ধরেন।
আবুল হোসেনকে বলা হয় ‘প্রথম আধুনিক-চেতনা, অবচেতনা, সফিসটিকেশনের কবি’। বাংলা কবিতার ধারা যদি এরকম হয়—বৈষ্ণব কবিতার যুগ, রবীন্দ্র-নজরুলের যুগ, মাইকেল মধুসূদনের যুগ ও আধুনিক বাংলা কবিতা; তাহলে বলতে হবে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাটা শুরু হয়েছে আবুল হোসেনের সময় থেকে। চল্লিশের দশকে তিনি বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেন; চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, একুশ শতাব্দীর শূন্য দশক ধরে সেই আধুনিকতারই নানামুখী চর্চা চলেছে এ দেশের কবিদের হাতে। কবি বিষ্ণু দে’র ‘এক সূত্রে’ কবিতা সঙ্কলনে মুসলমান আধুনিক কবিদের মধ্যে কেবল আবুল হোসেন আর গোলাম কুদ্দুসের কবিতাই ঠাঁই পেয়েছে।
সে জন্য তাঁকে কেবল ‘বাঙালি মুসলমানদের প্রথম আধুনিক কবি’ বলাটা এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা চর্চার মতো। কেননা, তিনি দুই বাংলার চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে আধুনিক কবি, অন্যতম প্রধান কবি। ত্রিশের দশকের কবিদের অকারণ ‘রবীন্দ্র বিরোধিতা’, ইউরোপের সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ আধুনিক কবিতা হিসেবে কালের বিচারে চিহ্নিত হয় না। তাদের কবিতায় সূক্ষ্মতার চেয়ে স্থূলতা অনেক বেশি। এসব বিবেচনায় চল্লিশের দশকেই আধুনিক কবিতার সূত্রপাত। জীবনের ধাপে ধাপে কবিতার বিষয় থেকে বিষয়ে গেছেন আবুল হোসেন অননুকরণীয়ভাবে। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন সব সময়। তাঁর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য, আর্শ্চয রকমের সরলতা। বলার ভঙ্গিটা এত চেনা যে, মনে হয় কবি পাঠকের সঙ্গে কথার বুনন নির্মাণ করে চলেছেন। অথচ ছন্দমিলের বৈচিত্র্যে প্রতিটি কবিতাই ঋদ্ধ। সরল বর্ণনাতেও ছড়িয়ে থাকে বুদ্ধির দীপ্তি, ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম আঁচড়, প্রতীক ও চিত্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগ। তিনিই বাংলা কবিতার একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা কবিতার তিন প্রধানতম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের সংস্পর্শে এসেছেন। তবে এখনও তিনি প্রতি মুহূর্তে তরুণ। প্রতি মুহূর্তে নবায়ন করেন নিজেকে তরুণতম, সবচেয়ে আধুনিক রাখতে।
এটাও সত্য, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য এক সত্য। এ উপমহাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোনো দেশের প্রধান ভাষায় লেখা সাহিত্যে এরকম সাম্প্রদায়িকতা আছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বকবি’, তিনি তাঁর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে তাকিয়েছেন খুব সামান্যই। মুসলমানদের নিয়ে তাঁর লেখার তালিকা টানতে গেলে রবীন্দ্রপ্রেমীদের ‘অসাম্প্রদায়িকতার গর্ববোধ’ ম্লান হয়ে যায়। আবার রবীন্দ্র সমসাময়িকের মুসলমান কবি-লেখক ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হকরাও নিজ ধর্মের বাইরে তাকাননি। সম্প্রদায়গত চিন্তা-চেতনা থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে কবি-লেখকদের মূল্যায়ন না করার মানসিকতা তখন ছিল ভয়াবহ রকমে প্রবল। হিন্দু ধর্মের অনুসারী কবি-লেখকদের এরকম মানসিকতা ছিল ভয়ানক রকমে। মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা অসাধারণ লিখতেন, তাদের মুসলমান কবি-লেখক বলে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কৌশলটার চর্চা আজও চলছে। তাতে এখন সেক্যুলার কয়েক মুসলমান কবিও যুক্ত আছেন। যারা আবুল হোসেনকে ‘গণ্ডির’ মধ্যে আটকে রাখতে চান, তাদের মধ্যে অনেকে কবিতা ও সাহিত্যের বিচারে আবুল হোসেনের পেছনের সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও রাখেন না।
আবুল হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট, বাগেরহাট জেলায়। ছেলেবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়। প্রথম যৌবন কলকাতায়। সাতচল্লিশে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান জন্মের দিন ১৪ আগস্ট চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নববসন্ত’ বের হয় ১৯৪০ সালে, কলকাতার বুলবুল পাবলিশিং হাউস থেকে। দ্বিতীয় বই ‘বিরস সংলাপ’ ঢাকা থেকে বের হয় ১৯৬৯ সালে। এরপর একে একে বের হয়—হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে, এখনো সময় আছে, রাজরাজড়া, কালের খাতায়, আমার এই ছোট ভুবন, আর এক ভুবন, দুঃস্বপ্নের কাল, স্বপ্নভঙ্গের পালা ইত্যাদি।
‘নববসন্ত’ বইটি কবি উত্সর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে বইটির কোনো কপি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আবুল হোসেনের মনে দুঃখবোধ জমে আছে। তাঁর মতে, ‘ওটা যতোদিন বেঁচে থাকি, ততোদিনই থাকবে।’ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘হে ধরণীর কবি’ নামে একটি কবিতা পাঠান। ওই কবিতা অক্ষরবৃত্তে ২৬ মাত্রায় লেখা ছিল। কবিতাটি পেয়ে লম্বা খামে ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠান রবীন্দ্রনাথ। তাতে লেখা ছিল ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের সাহিত্যগত বিতর্কও হয়েছে। ১৯৩৭ সালে আবুল হোসেনের প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ নিয়ে এ বিতর্ক হয়। ওই বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘গদ্য কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধই পরের বছর শোধিত-বর্ধিত হয়ে ‘গদ্য কবিতা ও তার ছন্দ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তিনি প্রবন্ধটিতে গদ্য কবিতার বিরুদ্ধে বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম—‘ছন্দ একেবারেই অপরিহার্য।’ রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনের এক অভিভাষণে আবুল হোসেনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। অবশ্য প্রবন্ধটি লেখার অল্পকাল পরে আবুল হোসেন নিজেও গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন, যা এখনও অব্যাহত আছে।
রবীন্দ্রনাথও ফিরে গেছেন গদ্য কবিতা থেকে ছন্দোবদ্ধ কবিতায়। দুই কবির এ বিতর্ক চিহ্নিত করতে বাংলা সাহিত্যের আরেক কবি-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘এসব হচ্ছে শিল্পীর শিল্প বিবেচনা থেকে শিল্প সৃজনের মজাদার বৈপরীত্য।’ বিতর্কের পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের দেখা ও কথাবার্তা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ‘রবীন্দ্র পরিষদ’-এর সম্পাদক হন তিনি ১৯৪৩ সালে।
নববসন্ত প্রকাশিত হওয়ার পর সেই সময়ের অগ্রজ কবি, সাহিত্য সমালোচক, বোদ্ধা মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। বইটির আলোচনা বেরোয় শওকত ওসমানের ‘চতুরঙ্গ’, গোলাম কুদ্দুসের ‘সওগাত’, আবুল মনসুর আহমদের ‘কৃষক’, সুবোধ সেন গুপ্তের ‘রূপায়ণ’, নীহার রঞ্জন রায়ের ‘কবিতা’সহ ওই সময়ের আরও অনেক পত্রিকায়। আবুল হোসেনের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার। তিনিও ‘নববসন্ত’র কবিতা নিয়ে কামাক্ষীপ্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতেন, যা তাঁর ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ নামে জীবনী বইয়ে লিখে গেছেন।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষে এসে পৌঁছেছেন আবুল হোসেন। বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে এমন নির্লোভ-নির্দলীয় কবি আর দ্বিতীয়জন নেই বলা যায়। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা করছেন। এ সময়ের মধ্যে দেখেছেন অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদ, কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষ, কলকাতায় জাপানি বোমার আক্রমণ, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে টানাপড়েন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারতবর্ষ ভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এরপর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নৈরাশ্য, সেনা বিদ্রোহ, সামরিক শাসন কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা। জীবন পরিক্রমায় দেখা প্রায় সব কিছুই উঠে এসেছে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীতে। পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লিখেছেন ‘সন্দিহান’ কবিতা। গোপাল ভৌমিকের সম্পাদনায় ‘পঞ্চাশে’ নামে ওই মন্বন্তর নিয়ে কবিতা সঙ্কলন বের হয়। তাতে ছিল আবুল হোসেনের ‘মেহেদির জন্য’ কবিতাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিরোধী কবিতা লেখার ধুম পড়ে। সমসাময়িক কবি আহসান হাবীব ‘হে অসি বাঁশরি হও’, সৈয়দ আলী আহসান লিখলেন—‘হে বাঁশি অসি হও’। আবুল হোসেন অসি, বাঁশি নিয়ে লেখেননি। তিনি লিখলেন ‘সৈনিক’ কবিতাটি। এ কবিতার ভাষা, ভাবনা তাঁকে চিহ্নিত করে তোলে সত্যিকার আধুনিক কবি হিসেবে। সেটি ১৯৩৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। পরে একাধিক পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে পুনর্মুদ্রিত হয়। কবি নিজে পরে কবিতাটির নাম বদলে করেছিলেন ‘ঘোড়সওয়ার’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘ঘোড়সওয়ার’ যুদ্ধবিরোধী কবিতা। তাঁর বিখ্যাত কবিতার মধ্যে আরও আছে ‘বাংলার মেয়ে’, ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’, ‘ডাইনামো ট্রেন’ ইত্যাদি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’য় ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’ প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পাহাড়ি ট্রেন পথের বর্ণনা। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের এক যাত্রা কবি এ কবিতায় সানন্দে ছন্দ, শব্দ, ধ্বনিতে বর্ণনা দেন। এরকম কবিতা বাংলা সাহিত্যে গবেষক-সমালোচকরা দ্বিতীয়টি এখনও খুঁজে পাননি।
অল্প বয়সেই লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন আবুল হোসেন। কুষ্টিয়া হাই স্কুলে এইটে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ‘আকবরের প্রতি রানা প্রতাপ’ নামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে মাইকেল মধুসূদনের অনুসরণে লেখা ছিল সেটি। ১৯৩৭ সালে ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে সে বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির পর কলেজের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ। এরপর চতুরঙ্গ, কবিতা, পূর্বাশা, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অরণি, নিরুক্ত, নবশক্তি, মাসপয়লা, পাঠশালা, শিশু সওগাত, নবযুগ, ত্রিকাল, রবিবার পত্রিকায় কবিতা, প্রবন্ধ, সাহিত্য-শিল্প, সংস্কৃতি সম্পর্কিত আলোচনা, ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রচুর লিখেছেন। এখন বাংলা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখছেন।
সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। ষাটের দশকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের সঙ্গে ‘সংলাপ’ পত্রিকা বের করেন। ত্রৈমাসিক এ পত্রিকার আটটি সংখ্যা বের হয় তিন বছরে। তখন ঢাকা থেকে খুব বেশি সাহিত্য পত্রিকা বেরুত না। দেশের বাইরের পত্রিকার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের অপেক্ষায় থাকতে হতো। তাদের তৃষ্ণা মেটানো, দলমতের বাইরে লেখকদের, বিশেষ করে নবীনদের একটা ফোরাম করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সেটি বের করেন। তাতে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরীর মতো কবি-লেখকরা লিখতেন।
তিনি অন্যের কবিতা অনুবাদও করেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা এ দেশে তিনিই প্রথম অনুবাদ করেন। এছাড়া এইচ জি ওয়েলসের ‘ঈড়ঁহঃত্ু ড়ভ ঃযব ইষরহফ’ ‘অন্ধের দেশ’ নামে, মার্ক টোয়েনের ‘গরষষরড়হ চড়ঁহফ ঘড়ঃব’ ‘দশ লাখ পাউন্ড’ নামে, ইসমত চুঘতাইয়ের ‘ছোট মা’ গল্প (ইংরেজি থেকে), আন্তন চেখভের গল্প, পাকিস্তানের কবি ইকবালের কবিতাও অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ ও সংলাপ পত্রিকায়। রুশ কবি রসুল গামজাতফ, আকবর উদ্দীন, দাগেস্তানের কবিতাও অনুবাদ করেছেন, যা বই আকারে বেরিয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের ইকবাল একাডেমির আমন্ত্রণে করাচিতে একাধিকবার ইকবালের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশ নেন তিনি।
তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন, পাশাপাশি সরকারি চাকরি, সমাজ উন্নয়নে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। এ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স নিয়ে এমএ পাস করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন। ছোট এ দেশে জনসংখ্যা তখন বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা। একটি পরিবার বলতে তখন বোঝাত আট/দশজনের সংসারকে। জন্মনিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিল সরকার। জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করতে ও পরিবার ছোট রাখতে সরকারের স্লোগান তৈরি হলো—‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’। এ স্লোগান আবুল হোসেনের দেয়া, যা এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাংলাদেশ সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দেন।লেখক হিসেবে ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামে ‘বাইঅ্যানিয়েল ইন্টারন্যাশনাল অব পোয়েট্রি’তে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সালে পাক-ভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পাকিস্তান দলের সদস্য, ১৯৭৩-এ সোভিয়েতের আলমা আতায় আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৮৩ সালে যুগোস্লাভিয়ার স্ট্রুগা কবিতা উত্সবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬০ সালে তত্কালীন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে অতিথি-লেখক হিসেবে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর ভ্রমণ করেন।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৪ সালে সিঙ্গাপুরে কলম্বো প্ল্যান কনসালটেটিভ কনফারেন্সে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে কলম্বোতে আইপিপিএফের আঞ্চলিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
লেখক জীবনের শুরুতেই আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ূন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ মনীষীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। শিক্ষক হিসেবে আরো পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, গৌরীনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ শিক্ষাব্রতীকে। তাঁর সাহিত্য রুচি ও মানস গঠনে এদের অবদান অপরিসীম।
আজীবন সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থাকলেও সরকারি চাকরি ছিল প্রধান পেশা। ৩৬ বছরের কর্মজীবনে দেশে ও বিদেশে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় তথ্য, রেডিও, টেলিভিশন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন ছিলেন। যেমন জনসংযোগ ও গবেষণা এবং তথ্য সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব পদে কাজ করে ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
লেখক হিসেবে এবং সরকারি কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সোভিয়েত রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপিন্স্, শ্রীলঙ্কা, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, লাওস ও গ্রিস ভ্রমণ করেন।
লেখার জন্য দেশ এবং সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সম্মানিত হয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারে, জনবার্তা স্বর্ণ পদকে, নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদকে, একুশে পদকে। আরো পেয়েছেন পদাবলী পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আবুল হাসনাত সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার এবং কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক ও পুরস্কার।
তাঁকে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন পথিক (সম্পাদক—তারেক মাহমুদ) দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অসাধারণ ওই দুই সংখ্যায় তার কবি, সাহিত্যের আলোচনা, মূল্যায়ন করেন দেশের খ্যাতিমান কবি, লেখক, প্রাবন্ধিকরা। পথিক-এর দুটির মধ্যে একটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, অন্যটি ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
আবুল হোসেনের ঘরোয়া জীবন হলো—১৯৫৮ সালে বিখ্যাত লেখক আকবর উদ্দীনের বড় মেয়ে সাহানা হোসেনকে বিয়ে করেন। সাহানা হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। তিনি কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থের রচয়িতা। ১৯৯৪ সালের ৮ মে আকস্মিকভাবে তিনি পরলোক গমন করেন। আবুল হোসেনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
আবুল হোসেন দীর্ঘদিন থেকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজস্ব বাসভবনে বসবাস করছেন।
আবুল হোসেন ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। ওই সাহিত্য সমিতির মাসিক সভায় একাধিকবার তিনি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় আয়োজিত এক সাহিত্য সভায় তিনি ‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সাধনা’ শিরোনামের এক প্রবন্ধ পড়েন। তাঁর এ প্রবন্ধ মুসলমান কবি-লেখকদের তখন নতুনভাবে ভাবিয়ে তোলে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটি সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয় কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে। প্রখাত সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ওই মননশীল সভার সভাপতি। সভায় আবুল হোসেন ‘আমাদের মননশীল সাহিত্য’ শিরোনামে প্রবন্ধ পড়েন। ওই প্রবন্ধও বাঙালি মুসলমান কবি-লেখকদের আলোড়িত, ভাবিত করে। প্রবন্ধটি কাজী মোতাহার হোসেন এত পছন্দ করেন যে, পড়া শেষ করতেই তিনি আবুল হোসেনকে জড়িয়ে ধরেন।
আবুল হোসেনকে বলা হয় ‘প্রথম আধুনিক-চেতনা, অবচেতনা, সফিসটিকেশনের কবি’। বাংলা কবিতার ধারা যদি এরকম হয়—বৈষ্ণব কবিতার যুগ, রবীন্দ্র-নজরুলের যুগ, মাইকেল মধুসূদনের যুগ ও আধুনিক বাংলা কবিতা; তাহলে বলতে হবে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাটা শুরু হয়েছে আবুল হোসেনের সময় থেকে। চল্লিশের দশকে তিনি বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেন; চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, একুশ শতাব্দীর শূন্য দশক ধরে সেই আধুনিকতারই নানামুখী চর্চা চলেছে এ দেশের কবিদের হাতে। কবি বিষ্ণু দে’র ‘এক সূত্রে’ কবিতা সঙ্কলনে মুসলমান আধুনিক কবিদের মধ্যে কেবল আবুল হোসেন আর গোলাম কুদ্দুসের কবিতাই ঠাঁই পেয়েছে।
সে জন্য তাঁকে কেবল ‘বাঙালি মুসলমানদের প্রথম আধুনিক কবি’ বলাটা এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা চর্চার মতো। কেননা, তিনি দুই বাংলার চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে আধুনিক কবি, অন্যতম প্রধান কবি। ত্রিশের দশকের কবিদের অকারণ ‘রবীন্দ্র বিরোধিতা’, ইউরোপের সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ আধুনিক কবিতা হিসেবে কালের বিচারে চিহ্নিত হয় না। তাদের কবিতায় সূক্ষ্মতার চেয়ে স্থূলতা অনেক বেশি। এসব বিবেচনায় চল্লিশের দশকেই আধুনিক কবিতার সূত্রপাত। জীবনের ধাপে ধাপে কবিতার বিষয় থেকে বিষয়ে গেছেন আবুল হোসেন অননুকরণীয়ভাবে। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন সব সময়। তাঁর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য, আর্শ্চয রকমের সরলতা। বলার ভঙ্গিটা এত চেনা যে, মনে হয় কবি পাঠকের সঙ্গে কথার বুনন নির্মাণ করে চলেছেন। অথচ ছন্দমিলের বৈচিত্র্যে প্রতিটি কবিতাই ঋদ্ধ। সরল বর্ণনাতেও ছড়িয়ে থাকে বুদ্ধির দীপ্তি, ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম আঁচড়, প্রতীক ও চিত্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগ। তিনিই বাংলা কবিতার একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা কবিতার তিন প্রধানতম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের সংস্পর্শে এসেছেন। তবে এখনও তিনি প্রতি মুহূর্তে তরুণ। প্রতি মুহূর্তে নবায়ন করেন নিজেকে তরুণতম, সবচেয়ে আধুনিক রাখতে।
এটাও সত্য, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য এক সত্য। এ উপমহাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোনো দেশের প্রধান ভাষায় লেখা সাহিত্যে এরকম সাম্প্রদায়িকতা আছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বকবি’, তিনি তাঁর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে তাকিয়েছেন খুব সামান্যই। মুসলমানদের নিয়ে তাঁর লেখার তালিকা টানতে গেলে রবীন্দ্রপ্রেমীদের ‘অসাম্প্রদায়িকতার গর্ববোধ’ ম্লান হয়ে যায়। আবার রবীন্দ্র সমসাময়িকের মুসলমান কবি-লেখক ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হকরাও নিজ ধর্মের বাইরে তাকাননি। সম্প্রদায়গত চিন্তা-চেতনা থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে কবি-লেখকদের মূল্যায়ন না করার মানসিকতা তখন ছিল ভয়াবহ রকমে প্রবল। হিন্দু ধর্মের অনুসারী কবি-লেখকদের এরকম মানসিকতা ছিল ভয়ানক রকমে। মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা অসাধারণ লিখতেন, তাদের মুসলমান কবি-লেখক বলে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কৌশলটার চর্চা আজও চলছে। তাতে এখন সেক্যুলার কয়েক মুসলমান কবিও যুক্ত আছেন। যারা আবুল হোসেনকে ‘গণ্ডির’ মধ্যে আটকে রাখতে চান, তাদের মধ্যে অনেকে কবিতা ও সাহিত্যের বিচারে আবুল হোসেনের পেছনের সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও রাখেন না।
আবুল হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট, বাগেরহাট জেলায়। ছেলেবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়। প্রথম যৌবন কলকাতায়। সাতচল্লিশে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান জন্মের দিন ১৪ আগস্ট চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নববসন্ত’ বের হয় ১৯৪০ সালে, কলকাতার বুলবুল পাবলিশিং হাউস থেকে। দ্বিতীয় বই ‘বিরস সংলাপ’ ঢাকা থেকে বের হয় ১৯৬৯ সালে। এরপর একে একে বের হয়—হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে, এখনো সময় আছে, রাজরাজড়া, কালের খাতায়, আমার এই ছোট ভুবন, আর এক ভুবন, দুঃস্বপ্নের কাল, স্বপ্নভঙ্গের পালা ইত্যাদি।
‘নববসন্ত’ বইটি কবি উত্সর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে বইটির কোনো কপি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আবুল হোসেনের মনে দুঃখবোধ জমে আছে। তাঁর মতে, ‘ওটা যতোদিন বেঁচে থাকি, ততোদিনই থাকবে।’ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘হে ধরণীর কবি’ নামে একটি কবিতা পাঠান। ওই কবিতা অক্ষরবৃত্তে ২৬ মাত্রায় লেখা ছিল। কবিতাটি পেয়ে লম্বা খামে ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠান রবীন্দ্রনাথ। তাতে লেখা ছিল ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের সাহিত্যগত বিতর্কও হয়েছে। ১৯৩৭ সালে আবুল হোসেনের প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ নিয়ে এ বিতর্ক হয়। ওই বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘গদ্য কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধই পরের বছর শোধিত-বর্ধিত হয়ে ‘গদ্য কবিতা ও তার ছন্দ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তিনি প্রবন্ধটিতে গদ্য কবিতার বিরুদ্ধে বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম—‘ছন্দ একেবারেই অপরিহার্য।’ রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনের এক অভিভাষণে আবুল হোসেনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। অবশ্য প্রবন্ধটি লেখার অল্পকাল পরে আবুল হোসেন নিজেও গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন, যা এখনও অব্যাহত আছে।
রবীন্দ্রনাথও ফিরে গেছেন গদ্য কবিতা থেকে ছন্দোবদ্ধ কবিতায়। দুই কবির এ বিতর্ক চিহ্নিত করতে বাংলা সাহিত্যের আরেক কবি-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘এসব হচ্ছে শিল্পীর শিল্প বিবেচনা থেকে শিল্প সৃজনের মজাদার বৈপরীত্য।’ বিতর্কের পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের দেখা ও কথাবার্তা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ‘রবীন্দ্র পরিষদ’-এর সম্পাদক হন তিনি ১৯৪৩ সালে।
নববসন্ত প্রকাশিত হওয়ার পর সেই সময়ের অগ্রজ কবি, সাহিত্য সমালোচক, বোদ্ধা মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। বইটির আলোচনা বেরোয় শওকত ওসমানের ‘চতুরঙ্গ’, গোলাম কুদ্দুসের ‘সওগাত’, আবুল মনসুর আহমদের ‘কৃষক’, সুবোধ সেন গুপ্তের ‘রূপায়ণ’, নীহার রঞ্জন রায়ের ‘কবিতা’সহ ওই সময়ের আরও অনেক পত্রিকায়। আবুল হোসেনের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার। তিনিও ‘নববসন্ত’র কবিতা নিয়ে কামাক্ষীপ্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতেন, যা তাঁর ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ নামে জীবনী বইয়ে লিখে গেছেন।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষে এসে পৌঁছেছেন আবুল হোসেন। বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে এমন নির্লোভ-নির্দলীয় কবি আর দ্বিতীয়জন নেই বলা যায়। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা করছেন। এ সময়ের মধ্যে দেখেছেন অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদ, কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষ, কলকাতায় জাপানি বোমার আক্রমণ, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে টানাপড়েন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারতবর্ষ ভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এরপর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নৈরাশ্য, সেনা বিদ্রোহ, সামরিক শাসন কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা। জীবন পরিক্রমায় দেখা প্রায় সব কিছুই উঠে এসেছে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীতে। পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লিখেছেন ‘সন্দিহান’ কবিতা। গোপাল ভৌমিকের সম্পাদনায় ‘পঞ্চাশে’ নামে ওই মন্বন্তর নিয়ে কবিতা সঙ্কলন বের হয়। তাতে ছিল আবুল হোসেনের ‘মেহেদির জন্য’ কবিতাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিরোধী কবিতা লেখার ধুম পড়ে। সমসাময়িক কবি আহসান হাবীব ‘হে অসি বাঁশরি হও’, সৈয়দ আলী আহসান লিখলেন—‘হে বাঁশি অসি হও’। আবুল হোসেন অসি, বাঁশি নিয়ে লেখেননি। তিনি লিখলেন ‘সৈনিক’ কবিতাটি। এ কবিতার ভাষা, ভাবনা তাঁকে চিহ্নিত করে তোলে সত্যিকার আধুনিক কবি হিসেবে। সেটি ১৯৩৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। পরে একাধিক পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে পুনর্মুদ্রিত হয়। কবি নিজে পরে কবিতাটির নাম বদলে করেছিলেন ‘ঘোড়সওয়ার’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘ঘোড়সওয়ার’ যুদ্ধবিরোধী কবিতা। তাঁর বিখ্যাত কবিতার মধ্যে আরও আছে ‘বাংলার মেয়ে’, ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’, ‘ডাইনামো ট্রেন’ ইত্যাদি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’য় ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’ প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পাহাড়ি ট্রেন পথের বর্ণনা। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের এক যাত্রা কবি এ কবিতায় সানন্দে ছন্দ, শব্দ, ধ্বনিতে বর্ণনা দেন। এরকম কবিতা বাংলা সাহিত্যে গবেষক-সমালোচকরা দ্বিতীয়টি এখনও খুঁজে পাননি।
অল্প বয়সেই লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন আবুল হোসেন। কুষ্টিয়া হাই স্কুলে এইটে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ‘আকবরের প্রতি রানা প্রতাপ’ নামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে মাইকেল মধুসূদনের অনুসরণে লেখা ছিল সেটি। ১৯৩৭ সালে ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে সে বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির পর কলেজের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ। এরপর চতুরঙ্গ, কবিতা, পূর্বাশা, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অরণি, নিরুক্ত, নবশক্তি, মাসপয়লা, পাঠশালা, শিশু সওগাত, নবযুগ, ত্রিকাল, রবিবার পত্রিকায় কবিতা, প্রবন্ধ, সাহিত্য-শিল্প, সংস্কৃতি সম্পর্কিত আলোচনা, ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রচুর লিখেছেন। এখন বাংলা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখছেন।
সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। ষাটের দশকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের সঙ্গে ‘সংলাপ’ পত্রিকা বের করেন। ত্রৈমাসিক এ পত্রিকার আটটি সংখ্যা বের হয় তিন বছরে। তখন ঢাকা থেকে খুব বেশি সাহিত্য পত্রিকা বেরুত না। দেশের বাইরের পত্রিকার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের অপেক্ষায় থাকতে হতো। তাদের তৃষ্ণা মেটানো, দলমতের বাইরে লেখকদের, বিশেষ করে নবীনদের একটা ফোরাম করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সেটি বের করেন। তাতে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরীর মতো কবি-লেখকরা লিখতেন।
তিনি অন্যের কবিতা অনুবাদও করেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা এ দেশে তিনিই প্রথম অনুবাদ করেন। এছাড়া এইচ জি ওয়েলসের ‘ঈড়ঁহঃত্ু ড়ভ ঃযব ইষরহফ’ ‘অন্ধের দেশ’ নামে, মার্ক টোয়েনের ‘গরষষরড়হ চড়ঁহফ ঘড়ঃব’ ‘দশ লাখ পাউন্ড’ নামে, ইসমত চুঘতাইয়ের ‘ছোট মা’ গল্প (ইংরেজি থেকে), আন্তন চেখভের গল্প, পাকিস্তানের কবি ইকবালের কবিতাও অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ ও সংলাপ পত্রিকায়। রুশ কবি রসুল গামজাতফ, আকবর উদ্দীন, দাগেস্তানের কবিতাও অনুবাদ করেছেন, যা বই আকারে বেরিয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের ইকবাল একাডেমির আমন্ত্রণে করাচিতে একাধিকবার ইকবালের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশ নেন তিনি।
তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন, পাশাপাশি সরকারি চাকরি, সমাজ উন্নয়নে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। এ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স নিয়ে এমএ পাস করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন। ছোট এ দেশে জনসংখ্যা তখন বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা। একটি পরিবার বলতে তখন বোঝাত আট/দশজনের সংসারকে। জন্মনিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিল সরকার। জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করতে ও পরিবার ছোট রাখতে সরকারের স্লোগান তৈরি হলো—‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’। এ স্লোগান আবুল হোসেনের দেয়া, যা এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাংলাদেশ সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দেন।লেখক হিসেবে ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামে ‘বাইঅ্যানিয়েল ইন্টারন্যাশনাল অব পোয়েট্রি’তে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সালে পাক-ভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পাকিস্তান দলের সদস্য, ১৯৭৩-এ সোভিয়েতের আলমা আতায় আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৮৩ সালে যুগোস্লাভিয়ার স্ট্রুগা কবিতা উত্সবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬০ সালে তত্কালীন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে অতিথি-লেখক হিসেবে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর ভ্রমণ করেন।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৪ সালে সিঙ্গাপুরে কলম্বো প্ল্যান কনসালটেটিভ কনফারেন্সে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে কলম্বোতে আইপিপিএফের আঞ্চলিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
লেখক জীবনের শুরুতেই আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ূন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ মনীষীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। শিক্ষক হিসেবে আরো পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, গৌরীনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ শিক্ষাব্রতীকে। তাঁর সাহিত্য রুচি ও মানস গঠনে এদের অবদান অপরিসীম।
আজীবন সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থাকলেও সরকারি চাকরি ছিল প্রধান পেশা। ৩৬ বছরের কর্মজীবনে দেশে ও বিদেশে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় তথ্য, রেডিও, টেলিভিশন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন ছিলেন। যেমন জনসংযোগ ও গবেষণা এবং তথ্য সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব পদে কাজ করে ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
লেখক হিসেবে এবং সরকারি কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সোভিয়েত রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপিন্স্, শ্রীলঙ্কা, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, লাওস ও গ্রিস ভ্রমণ করেন।
লেখার জন্য দেশ এবং সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সম্মানিত হয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারে, জনবার্তা স্বর্ণ পদকে, নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদকে, একুশে পদকে। আরো পেয়েছেন পদাবলী পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আবুল হাসনাত সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার এবং কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক ও পুরস্কার।
তাঁকে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন পথিক (সম্পাদক—তারেক মাহমুদ) দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অসাধারণ ওই দুই সংখ্যায় তার কবি, সাহিত্যের আলোচনা, মূল্যায়ন করেন দেশের খ্যাতিমান কবি, লেখক, প্রাবন্ধিকরা। পথিক-এর দুটির মধ্যে একটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, অন্যটি ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
আবুল হোসেনের ঘরোয়া জীবন হলো—১৯৫৮ সালে বিখ্যাত লেখক আকবর উদ্দীনের বড় মেয়ে সাহানা হোসেনকে বিয়ে করেন। সাহানা হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। তিনি কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থের রচয়িতা। ১৯৯৪ সালের ৮ মে আকস্মিকভাবে তিনি পরলোক গমন করেন। আবুল হোসেনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
আবুল হোসেন দীর্ঘদিন থেকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজস্ব বাসভবনে বসবাস করছেন।
No comments:
Post a Comment