Sunday, February 3, 2019

টানা গদ্য কবিতা : সতত ডানায় এক জন্মান্ধজনের রসাতল যাত্রা - রাশেদুজ্জামান


টানা গদ্য কবিতা : সতত ডানায় এক জন্মান্ধজনের রসাতল যাত্রা

                            - রাশেদুজ্জামান



  এক.নাট্যকার মলিয়ের মজা করে বলেছিলেন, All that is not prose is verse; and all that is not verse is prose. মলিয়েরের যুগ হতে কয়েকশো বছর দূরে সরে এসে আজ দেখি, কবিতারই রয়েছে  সুনির্দিষ্ট পরিচয়-সংকট। কবিতা যে কী, কিংবা কোনটা যে কবিতা নয় তা বোঝা আরও দুরূহ হয়ে উঠেছে এতদিনে। কবিতার ধ্বনিসজ্জা ছন্দিত, ভাব-পরিবেশ ছোঁয়া-যায়-কি-যায়-না এমন, আর ভাষা নিত্যদিনকার নয়,উপমা-রূপক-প্রতীক-চিত্রকল্প দিয়ে সুরতি। 



   কোনো শক্তিশালী আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত উসারণ হচ্ছে কবিতাএমন কথাও শোনা গিয়েছিলো। কিন্তু শ্রুতিমধুর এ উক্তি যে কবিতাকে চেনায় নাতা বলা চলে। হ্যামলেটের সংলাপে যত কাব্যিক মধুরতা থাকুকওটি তো কবিতা নয়নাটকই। আর হেরমান হেসের সিদ্ধার্থও একটি উপন্যাস বা বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদে যতই ক্যারিশমা থাকুকসেটিও কবিতা নয়,ধর্মগ্রন্থ। তাহলে টানা গদ্য কবিতা বলে যে লেখাগুলোকে দাবি করা হচ্ছে,তা যে কবিতাইকী প্রকারে নির্ধারিত হবে আসলে সুস্থির মানদণ্ডে বিচার অসম্ভবকেননা মানদণ্ডের নিজেরই মান ত্রুটিপূর্ণ। এ সমস্ত প্রসঙ্গের অবতারণা এই কারণে যেটানা গদ্য কবিতা আবির্ভূত হওয়ার দেড়শো বছরের বেশি পার হবার পর এই বঙ্গ ভূখণ্ডে দেখতে পাচ্ছি টানা গদ্য কবিতা রচনার হিড়িক পড়ে গেছে। বিষয়টি তরুণদের ক্ষেত্রে ত্রইএবংব্যাপক মাত্রায়। এর কারণ কি এই যেকবিতায় ছন্দের প্রয়োজন অবান্তর হয়ে গেছে বলে তারা ভাবছেন কিংবা যে কবিতাগুলো তাদের হাত থেকে বেরুচ্ছেতার জন্য টানা গদ্যই অপরিহার্য ফর্মবাএভাবে কবিখ্যাতি আয়ত্ত করা বেশ স্বস্তিকর? ? বিষয়টি নিয়ে ভাবা এখন আমাদের খুব গুরুত্ববহ বলে মনে হচ্ছে। বাংলা কবিতার ভবিষ্য যাদের হাতেসেই তরুণরা কি ছন্দহীনতার নতুন ঐতিহ্যবরণ করতে যাচ্ছেন সে তারা যা-ই করুনকবিকে টিকতে কিন্তু হবে কবিতার জোরেআর কবিতাকে শিল্পের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে।

দুই.
   আমরা যাকে বর্তমানে টানা গদ্য কবিতা বলছি
 ইংরেজিতে তা Prose Poem নামে পারচিত। Prose Poem বলতে বোঝানো হয়ে থাকে এমন কবিতাকে যা বহন করে কবিতার সমস্ত গুণাবলীযদিও দেখতে গদ্যের মতো। গদ্যাকারে সাজানো হলেও এর ভাষা কবিতার মতো সুললিতঅন্তর্লীন ছন্দপ্রবাহে গতিশীলআবেগ সংক্রামককল্পনার জগতেরউপমা-চিত্রকল্পে আবৃত এবং এর অভিঘাত কবিতারই। আসলে টানা গদ্যের মাধ্যমে কবিতা তার প্রথাগত চেহারা থেকে সরে এসেছে। আধারের বিভিন্নতা ত্যাগ করে হয়ে উঠেছে আধেয়-নির্ভর।
   প্রশ্ন জাগতে পারে গদ্য তো টেনেই লেখা হয়তাহলে এই ফর্মটিকে টানা গদ্য কবিতা বলার কারণ কী আসলে ইংরেজিতে যাকে free verse বলে,বাংলায় তার নাম দেওয়া হয়েছে গদ্য কবিতা এবং এটি কিন্তু কবিতার প্রথাগত চেহারাতেই রচিত হয়েছে (free verse কে গদ্য কবিতা বলা সঙ্গত কিনা তা ভেবে দেখা উচিত। গদ্য শব্দটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মনে গদ্যের আকৃতিটিও ভেসে ওঠেএবং প্রকৃতিওসেখানে কবিতার প্রচলিত ছন্দের কোনো জায়গা নেই। free verse কে গদ্য ছন্দ না বলে একে মুক্ত ছন্দ [মুক্তক নয়] বলা যেতে পারেকেননা ছন্দের নিয়মিত পর্বভেদ এতে নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও সূক্ষ্মভাবে ছন্দশাসন থাকে। দেখা যায় একটি ছন্দ-পর্ব আরেকটির মধ্যে এমনভাবে ঢুকে পড়ে যে সবসময় তাকে আলাদা করা যায় নাএবং তা সত্ত্বেও তার উপস্থিতি থাকে) । এর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিংবা সমর সেনের  বা অন্য কোনো কবির গদ্য কবিতা স্মরণ করতে পারি। এই গদ্য কবিতাকে টেনে গদ্যের মতো সাজালে যে চেহারা পাওয়া যাবেতা-ই টানা গদ্য কবিতা। এটা প্রচলিত মত। কিন্তু ছন্দে কবিতা লিখে যদি তা গদ্যের মতো করে সাজানো যায়তাহলেও কি তা টানা গদ্য কবিতা নামে চিহ্নিত হবে হাল আমলে অনেককেই আমরাদেখছি গদ্যের মতো লিখলেও ভেতরে প্রথানুগ ছন্দ ব্যবহার করছেন। আমরা অবশ্য এখানে প্রচলিত পরিভাষাই ব্যবহার করবো।

তিন.
   Writing free verse is like playing tennis with the net down,বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। এই উক্তিটিকে ব্যজস্তুতি হিসেবে নিলে দাঁড়ায় : গদ্য কবিতা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ কেননা ছন্দ নেই কিন্তু তার অদৃশ্য উপস্থিতিকে (ছন্দতো খানিকটা চোখে দেখার ব্যপারও) অক্ষন্ন রাখতে হয়। এটি দক্ষ শিল্পীর কাজই বটে। পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনি :

   গদ্যকাব্যে অতি নিরূপিত ছন্দের বন্ধনকে ভাঙাই যথেষ্ট নয়পদ্যকাব্যে ভাষার প্রকাশরীতিতে যে সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস
   বাংলায় গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথ যখন লিখতে শুরু করেন তখন যে সমস্যাগুলো অতিক্রম করতে হবে ভেবেছিলেনতা এখানে বলতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের হাতে পুনশ্চ কাব্যে গদ্যছন্দে যে কবিতা আমরা পেয়েছিতা বাংলা টানা গদ্য কবিতার পথিকৃ অনেকটাই। অবশ্য লিপিকার ভূমিকাকেও ছোট করে দেখলে চলবে না।  আমাদের ধারণা : ছন্দমুক্তির একটি চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে এই টানা গদ্য কবিতা। মধুসূদনের হাতে যখন অমিত্রার ছন্দের আবির্ভাব হলো তখন সবচেয়ে বড় পদপেটি আসলে রচিত হয়ে গেল। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তকের আবির্ভাব বলা যেতে পারে। সেখান থেকে গদ্য ছন্দে যাত্রা একটি বড়সর লম্ফ বটে। কিন্তু মনে রাখতে চাই গীতাঞ্জলির যে গানগুলি বিশ্বের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম আকর্ষণ করতে পেরেছিলোসেসব আসলে ইংরেজি গদ্যে অনূদিত হয়েও পেরেছিলো। এটি রচয়িতাকে তো বটেই অন্যদেরও সাহস জুগিয়েছিলো বলতে হবে। বাংলা ভাষার প্রথম গদ্যছন্দে রচিত কবিতার কবি হচ্ছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। রবীন্দ্রনাথসমর সেন বা অন্য কারোর পদ্যঢঙে লেখা কবিতাকে (প্রথাগত কবিতার পঙক্তির মতো সাজানো কবিতাকে) যদি গদ্যের মতো সাজিয়ে দেইতাহলে কি তা ব্যর্থ হয়ে যাবে আমাদের বিশ্বাস সব ক্ষেত্রে তা সফল হবে না। প্রথমে প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই পঙ্ক্তি কটি  পাঠ করা যাক ওপরে তার টানা গদ্যের রূপটিও
১.(ক) সেইসব হারানো পথ আমাকে টানে
         কেরমানের নোনা মরুর ওপর দিয়ে,
         খোরাশান থেকে বাদক্শান,
         পামিরের তুষার-পৃষ্ঠ ডিঙিয়েইয়াকন্দ থেকে খোটান
         শ্রান্ত উটের পায়ে পায়ে যেখানে উড়েছে মরুর বালি,
         চমরীর ক্ষুরে লেগেছে বরফ-গলা কাদা 
         বাদকশানের চুনি আর খোটানের নীলার নিষ্ঠুর ঝিলিক-দেওয়া,   
         ভেঙে-পড়া ক্যারাভানের কঙ্কালে আকীর্ণ
         লুব্ধ বণিক আর দুরন্ত দুঃসাহসীর পথ
         লাদাকের কস্তুরীর গন্ধ যেখানে আজো লেগে আছে পুরানো স্মৃতির মতো
                                                                                         (পথ,সম্রাট)

১.(খ)   সেইসব হারানো পথ আমাকে টানে; —কেরমানের নোনা মরুর ওপর দিয়েখোরাশান থেকে বাদক্শানপামিরের তুষার-পৃষ্ঠ ডিঙিয়ে,ইয়াকন্দ থেকে খোটান। শ্রান্ত উটের পায়ে পায়ে যেখানে উড়েছে মরুর বালিচমরীর ক্ষুরে লেগেছে বরফ-গলা কাদা। বাদকশানের চুনি আর খোটানের নীলার নিষ্ঠুর ঝিলিক-দেওয়াভেঙে-পড়া ক্যারাভানের কঙ্কালে আকীর্ণলুব্ধ বণিক আর দুরন্ত দুঃসাহসীর পথজ্জলাদাকের কস্তুরীর গন্ধ যেখানে আজো লেগে আছে পুরানো স্মৃতির মতো।
   আমাদের ধারণা এখানে ১.ক-তে যে উদাত্ততা আছে তা পরের অংশে অর্থা ১.খ-তে নেই। একইভাবে সমর সেনের কবিতাগুলিকে যদি গদ্যের মতো সাজানো যায়তার ফলও নেতিবাচক হবে। টানা গদ্যে গতি চারিয়ে দেওয়া যায়যেমন মান্নান সৈয়দ দিয়েছেন। যেখানে কবিতাটি আখ্যানকে সঙ্গী করেছে সেখানেও এটি সফল হতে পারে। জীবনানন্দের শিকার কবিতাটি নিয়ে এই নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে। কিন্তু অন্ধকার কবিতাটির বেলায় এই প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। আবারআখ্যান থাকলেওতা যদি উদাত্ত স্বভাবের হয়যেমনরবীন্দ্রনাথেরই শিশুতীর্থতা সফল হবে না সম্ভবত। গদ্যের মধ্যে যে গড়িয়ে গড়িয়ে চলার প্রবণতা আছে,আছে পরের বাক্যটিকে স্পর্শ করার স্বভাবসেটি তো পদ্যঢঙে নেই। পদ্যঢঙে যেটি আছেসেটি আবার তার নিজস্বপঙক্তিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে একাকীবিচ্ছিন্ন ও শূন্যতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে যেন। প্রচল চেহারার কবিতা হচ্ছে অনেকটা গাছের মতোযে মৃত্তিকায় জন্মালেও সোজা উঠে গিয়ে আলিঙ্গন করতে চায় মেঘলোককে আর অন্যদিকে টানা গদ্য কবিতার ধরন যেন লতা স্বভাবেরযার প্রকৃতি কোনো কিছুকে আকড়ে অগ্রসর হওয়া সে ছুঁতে চায় দিগন্তকে।


   ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে জর্মন কবি নোভালিস প্রেমিকার মৃত্যুজনিত বিষাদকে রূপ দিলেন
 Hymnen an die Nacht (1800; Hymns to the Nightগ্রন্থে। টানা গদ্যে লেখা এই ছয়টি কবিতার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে ছন্দিত পঙক্তিও। কবি হোল্ডার্লিনও লিখেছিলেন কিছু এমন কবিতা। এদেরই দিতে পারি প্রবর্তকের শিরোপা। ফরাসিদের মধ্যে প্রথম এ ধরনের কবিতা  লেখেন বার্ট্রান্ড লুইস। তার এধংঢ়ধফ ফব ষধ হঁরঃ Gaspard de la nuit (1842; “Gaspard of the Night”) নামের বইটির মাধ্যমে টানা গদ্য কবিতার সূত্রপাত হলো,যদিও এটি তার জীবদ্দশায় তেমন গুরুত্ব পায়নি (তিনি অবশ্য স্মরণীয় হয়ে ওঠেন প্রতীকবাদী আন্দোলনের আদি-গুরু হিসেবে)। কিন্তু তার মৃত্যুর পর শার্ল বোদলেয়ারযিনি আধুনিকতাবাদী কবিতার জনয়িতা ও দণ্ডিত শহিদকবিতার ছন্দ-প্রশাসন ভাঙা এই নতুন ফর্মটিকে অমরতা দিলেন।Petite poèmes en prose নামের বইটি প্রকাশিত হলো তার মৃত্যুর পরে ১৮৬৯ সালে এবং পরে রচয়িতার ইচ্ছা অনুযায়ীএর নাম দেওয়া হলো :Le Spleen de Paris (Abyev‡` The Parisian Prowler, 2nd ed., 1997).. এভাবে পাঠকের সামনে এলো এমন লেখা যেটি প্রচারিত কবিতা হিসেবেকিন্তু তাতে নাই ছন্দের বালাইউপরন্তু দেখতে গদ্যের মতো। ভাষার জায়গাতে এটিকে যে গদ্যের সাথে মেলানো যায় নাতা সবাই দেখতে পেলেন। বোদলেয়ারের টানা গদ্য কবিতা Be Drunk থেকে:
And if sometimes, on the steps of a place or the green grass of a ditch, in the mournful solitude of your room, you wake again, drunkenness already diminishing or gone, ask the wind, the wave, the star, the bird, the clock, everything that is flying, everything that is groaning,  everything that is rolling, everything that is singing, everything that is speaking…ask what time it is and wind, wave, star, bird, clock will answer you : “It is time to be drunk! So as not to be the martyred slaves of time, be drunk, be continually drunk! On wine, on poetry or on virtue as you wish.” 

   এরপর মালার্মের হাত থেকেও বেরিয়ে এসেছে বেশ কিছু টানা গদ্য কবিতা। ফরাসিদের এই ধরনের কবিতার ঐতিহ্য ভালোই আছে। কিন্তু ইংরেজিতে টানা গদ্য সম্ভব নয়এমন ধারণাই চালু ছিলো দীর্ঘদিন ম্যথু আর্নল্ড এর প্রয়াস সত্ত্বেও। ষাট-সত্তরের দশকে এই ধারণা পাল্টে যায় আমেরিকানদের হাতেরবার্ট ব্লাইএ্যালেন গিন্সবার্গচার্লস সিমিকজেমস রাইটরাসেল এডসন প্রমুখ কবির প্রয়াসে। আর আশির দশকে এটি গুরুত্ব পেতে শুরু করে বিভিন্ন সংকলনে ঠাঁই দেয়া হতে থাকে টানা গদ্য কবিতাকে। একক সংকলনও প্রকাশিত হতে থাকে। সারা বিশ্বেই এই ফর্মটি ছড়িয়েছেগৃহীত ও অভ্যর্থিত হয়েছে। ¯প্যানিশ ভাষায় অক্টাবিও পাজও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তার Eagle or Sun?? গ্রন্থে। একই ভাষার অপর দুই কবি এঞ্জেল ক্রেসপো ও গিয়ান্নিনা ব্রাশি করেছেন সবচেয়েউল্লেখযোগ্য কাজ। দ্বিতীয়জন পাঠকের সামনে উপস্থিত করতে পেরেছেন টানা গদ্য কবিতার একটি ট্রিলজি, El imperio de los suenos (1988, Empire of Dreams)


   সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সময়ে গদ্য কবিতা রচনার হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো
 আর তা দেখে যুগপ হতাশ ও বিরক্ত হয়েতিনি ওগুলোর নাম দিয়েছিলেন, ‘বাক-সর্বস্ব ভূতের বাসা’ ! কারণ তার বিবেচনায় কবি-প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য। অবশ্য কেবল রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতাগুলোকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন এই যুক্তিতে যেরবীন্দ্রনাথের দীর্ঘজীবনব্যাপী সাধনার প্রেক্ষিতে বিষয়টি স্বাভাবিক। বর্তমান বাংলাদেশে যেভাবে দুহাতে টানা গদ্য কবিতা লেখা হচ্ছেতা দেখলে কেমন বোধ করতেন তিনি ?মনে হয় অত্যন্ত বিমর্ষ বোধ করতেন। তিনি নিজে ভেবেছিলেনএকসময় গদ্য ও পদ্যের কৃত্রিম ব্যবধান উঠে যাবেআর তা অনিবার্য শিল্প পরিণতিএমন বিবেচনা থেকেই। বিখ্যাত প্রায় সব কবিই গদ্য ছন্দে লিখেছেন,হয়তো জাড্য কাটাতেও। টানা গদ্যে কবিতা লিখবার যে ঝোঁক তা এলো মূলত ষাটের দশকে। আর অত্যুতসাহ দেখা যাচ্ছে এই দশকে।  কিন্তু আমরা বাংলায় প্রথম টানা গদ্য কবিতা রচয়িতার মুকুট দেবো কাকে ?আমাদের বিশ্বাস এক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথই এর কৃতিত্বভাগী। তার লিপিকার বেশ কিছু লেখা কোনো সন্দেহ ছাড়াই যে কবিতাতা বলা যায়। আমরা এ বিষয়েও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মত গ্রহণ করতে পারি। তিনিও এগুলোকে বলেছিলেন গদ্যবেশী কাব্য। পায়ে চলার পথপ্রভাত ও রাত্রি ইত্যাদি লেখাগুলোবলেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ, ‘যে-মুহূর্তে চেচিয়ে পড়া যায়তখনই এদের কাব্যরূপ ফুটে ওঠে।’ ওই রচনাগুলোতে তিনি ল করেছিলেন উপমার স্বপ্নময়তাচিত্রময়তা। মালার্মের একনিষ্ঠ অনুসারী হলেওতার মনে হয়তো মালার্মে রচিত টানা গদ্য বিষয়ে দ্বিধা ছিলো বা এই ফর্মটাকে তার ক্ল্যাসিক-মন পুরো গ্রহণ করে নিতাই তিনি লিপিকার ওই লেখাগুলোকেঅকুণ্ঠ ভাষায় কাব্য বলেন নি। ওগুলো যে কবিতা এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনের দ্বিধা পরে কেটে গিয়েছিলো । আমরা দেখি বুদ্ধদেব তার আধুনিক কবিতার সংকলনেও লিপিকার থেকে কবিতা অন্তর্ভুক্ত করছেন। পুনশ্চের ভূমিকা থেকে আবার উদ্ধৃত করিরবীন্দ্রনাথ বলছেন :
ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মতো খণ্ডিত করা হয় নিবোধ করি ভীরুতাই তার কারণ 
 আজকের বিবেচনা থেকে বুঝিওগুলো আসলে টানা গদ্য কাবতারবীন্দ্রনাথ টানা গদ্য কবিতার সচেতন স্রষ্টা ননকিন্তু প্রথম স্রষ্টা এবং প্রতিভার অনন্যতা এখানেও অবারিত :
 এখানে নামল সন্ধ্যা সূর্যদেবকোন্ দেশেকোন্ সমুদ্রপারেতোমার প্রভাত হল
 অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধাবাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নববধূর মতো ; কোন্খানে ফুটল ভোরবেলাকার কনকচাঁপা
 জাগল কে নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানো দীপফেলে দিল রাত্রে গাঁথা সেঁউতি ফুলের মালা
 এখানে একে একে দরজায় আগল পড়লসেখানে জানালা গেল খুলে এখানে নৌকো ঘাটে বাঁধামাঝি ঘুমিয়ে ; সেখানে পালে লেগেছে হাওয়া
ওরা পান্থশালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে
পূবের দিকে মুখ করে চলেছেওদের কপালে লেগেছে সকালের আলোওদের পারানির কড়ি এখনো ফুরোয় নি;ওদের জন্য পথের ধারের জানালায় জানালায় কালো চোখের করুণ কামনা অনিমেষ চেয়ে আছেরাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে,বললে, “তোমাদের জন্যে সব প্রস্তুত” 
 ওদের হৃদপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরী বেজে উঠল           
                                                                                                                                          (সন্ধ্যা ও প্রভাতলিপিকা)

   পরবর্তীকালের টানা গদ্য কবিতার মুখ্য বৈশিষ্ট্য এই কবিতাটির উদ্ধৃত অংশে আছে এবং চমকারিত্বও। কবির জিজ্ঞাসাঅনুযোগ কি বিস্ময়কে তিনি আড়াল করেছেন দাড়ি ব্যবহার করে। অন্যদিকে এর ভাষায় আছে গতিশীলতা। আবার ধ্বনির দিক যাচাই করলে দেখবোএই লেখাতে সূভাবে অরবৃত্তের এবং কখনো মাত্রাবৃত্তের একটি অন্তঃসলিলা প্রবাহ বিদ্যমান। গদ্য কবিতাতেও একটি সুর থাকা চাইযেটি লেখাটির ভাষাকে গদ্য থেকে পৃথক করবে। রবীন্দ্রনাথ এটি পেরেছেন।


   ফরাসি কবিতার অনুরাগী ও রেবোর অনুবাদক কবি অরুণ মিত্র টানা গদ্যে আদ্যন্ত
 একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেনসের দিকে (১৯৫৪খ্রি.)। বাংলায় এটি টানা গদ্য কবিতার প্রথম একক বই। ফরাসি প্রতীকবাদের দ্বারা স্পৃষ্ট এর গদ্য-বিন্যাস।
   ষাটের দশকের শেষের দিকে আবদুল মান্নান সৈয়দ যখন আদ্যন্ত-প্রায় টানাগদ্যে লেখা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ করলেনতখন দারুণ হৈচৈ পড়েগিয়েছিলোজমে উঠেছিলো বিতর্ক। একে তো পরাবাস্তববাদের অভিনবত্বের চাপ (জীবনানন্দের কিছু উদাহরণ বাদ দিলে)অন্য দিকে ছন্দ অস্বীকার করেকবিতার চেনা অবয়ব পাল্টেগদ্যের মতো সাজিয়ে পাঠককে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিলেন। এই বইয়ের আগেও টানা গদ্য বাংলাভাষী পাঠক লক্ষ করেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায় (জরাসন্ধ) কি শঙ্খ ঘোষের (দিনগুলি রাতগুলি) দু-একটি রচনায় ও অরুণ মিত্রের সের দিকে গ্রন্থে। কিন্তু এই বইয়ের মাধ্যমে বাংলাভাষায় টানা গদ্যের একটি বড় পদক্ষেপ আমরা দেখতে পেলাম। আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন তরুণ এবং ওটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই বইয়ের টানা গদ্যের বিশিষ্টতা ছিলো :
   ১. জ্যোস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়সব দরোজায়আমার চারিদিকে যতোগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের ; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশালবাস একটি নক্ষত্রপুলিশ একটি নক্ষত্রদোকান একটি নক্ষত্র : আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছেএরকম দৃশ্যে আমি অহত হয়ে শুয়ে আছি পথের উপরআমার পাপের দুচোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেলআর যে-আমার জন্ম হলো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সে : জ্যোস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপরদরোজা তার কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপরমৃত্যু তার কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর 
(
 অশোককাননজন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)
 
   ২. এই রাত্রিরা বেথেলহাম-কে ব্রথেলে পরিণত করে
করুণ কবাটের মতো ঝোলানো বাড়ির দেয়াল থেকে লুটিয়ে থাকে যেন বর্ম কিংবা বিরুদ্ধ পদ্ধতি হাওয়াররূপালি চাবির অভাবে এই রাত্রিরা সেই লাল আলোর ভালো যা তোমাকে প্রশস্ত স্ট্রীট থেকে নিয়ে যাবে কঙ্কালের সরু-সরু পথে,অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে;—যখন জানালায় ছিন্নপত্র ঝরে অবিচ্ছিন্নলোকালোক পুড়ে যায় বরফে এই রাত্রিরা জিরাফের গলা বেয়ে লতিয়ে উঠতে দেয় আগুনযেটা আমাদের আকাক্সাঅবশ্য যদি তার মাংস হতে রাজি হই তুমি আর আমি ; ঈশ্বর নামক গৃহপালিত মিস্তিরি ভুল সিঁড়ি বানাচ্ছে আমাদের উঠোনে বসেআগুনেরযে-অসম্ভবের সিঁড়িতে উঠতে-উঠতে আমরা সবাই পাতালে নেমে যাবো হঠা
 সিংহের খাঁচায় বসে আমি গল্প লিখছি মনে-মনে 
                                                        (পাগল এই রাত্রিরাজন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ)

   চিন্তার অভিনবত্বের সাথে ভাষায় যে ঘোর তৈরি করেছেন এখানে কবিতা পঠককে লেখাটি পুনর্পঠনে প্ররোচিত করে। পরাবাস্তবতার অচেনা মহলে প্রবেশ করিয়ে দ্রুত এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যেতে যেতে কবি অর্থ-উদ্ধারের আকাক্সাকে যেন ভুলিয়ে দেন। কবিতাগুলোপ্রচলিত ব্যাকরণকে পাশ কাটিয়ে অনাব্য স্ত্রীর মতো কেবলি অন্যদিকে যেতে প্ররোচিত করে,  যেহেতু লোকালোক পুড়ে যেতে থাকে বরফে। সিংহের খাঁচায় বসে লেখা এইসব গল্পের ভাষা বেশ দ্রুতগতির। তার টানা গদ্যের কবিতার বৈশিষ্ট্য মূলত এরকমই । অবশ্য বেশ প্রসন্ন ও মন্থর ভঙ্গির লেখাও তার আছে। পাঠকের মনে পড়বেএকই কাব্যগ্রন্থের পরস্পর কবিতাটি। টানাগদ্যে আখ্যান বা কাহিনি ব্যবহার করার চেষ্টা তার পরের দিকের দুএকটিকবিতায় ল করি। অবশ্য কবিতাগুলিকে সফল বলা যাবে না।
   এর পরে ষাটের দশকের আরেক তরুণ সিকদার আমিনুল হক সত্তুরের দশকে বের করলেন তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশযার অর্ধেক জুড়ে আছে এই টানা গদ্য। বাংলাভাষায় টানা গদ্যের তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে একনিষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠতম শিল্পী। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম বইয়ের পর দ্বিতীয় বইতে (জ্যোস্না ও রৌদ্রের চিকিসা) কিছু টানা গদ্যের কবিতা লক্ষ করিএবং পরে কবি এ থেকে আরও সরে আসেন। অন্যদিকে সিকদার আমিনুল হক প্রথম বইয়ের পর টানা গদ্য কবিতা লেখেন নি দীর্ঘকাল। নয়ের দশকে এসে পরিণত মনন নিয়ে প্রকাশ করলেন আদ্যন্ত টানা গদ্যকবিতার বই সতত ডানার মানুষ। সম্ভবত এটিই বাংলাভাষার প্রথম টানা গদ্য কবিতার বই (জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ-এ ছন্দে লেখা দুটো কবিতা রয়েছে।)। এর আরও পরে এলো তার একই ধারার আরও একটি কাব্যগ্রন্থ বাতাসের সঙ্গে আলাপ। আমরা জানি আকস্মিক মৃত্যু কবিকে ছিনিয়ে না নিলে তিনি টানা গদ্য কবিতার একটি ট্রিলজি পুরো করতেনযা শেষ হতো আদ্যন্ত টানা গদ্যের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশ থেকে এবার পাঠ করা যাক :
   আমাকে শিখতে হয়েছে সব একা
নবজাতকের মতো ঘ্রাণের মধ্যে আমি ঝড়ো হাওয়ার চিহ্ন পাই অশ্রুত পথের পাশে দাড়িয়ে মৌমাছির মতো বলতে পারি সোজাসুজি ফুলেদের নাম তবু সে বালক কোনো সম্মান পায় নি!
    এখন বিষয়বস্তুর মধ্যে তাই জল বার বার ফিরে আসে সমুদ্র থেকে ফিরে এলে নাবিকের স্বপ্নের ভিতরে যেমন ফিরে আসে হাঙরের ঝাঁঝালো জিহ্বা,অথবা হৃতবস্ত্র নারীর জঙ্ঘার উপরে বারবার ফিরে আসে যেমন ধর্ষণের বাতাস!….
 অহঙ্কারের শেষ হয়েছে আমি তাই জলের মধ্যে বার বার ফিরে আসি এই ভাবে জন্ম নেয় সমুদ্র আর্দ্র নির্লজ্জ নারীর হাতে সমুদ্রের আক্রমণ যা প্রতি প্রত্যূষে আমার রক্তকে রঞ্জিত করে
 আমাদের জন্ম-জন্মান্তর জলের মধ্যে সেই বিশাল পদচিহ্নের ইতিহাসআমাদের ওষ্ঠদেশ সেই লবণচিহ্ন থেকে এখনো পরিত্রাণ পায়নি…..
  (বৃত্তান্তদূরের কার্নিশ )

   গতির দ্রুততা ও চিত্রের উল্লম্ফন সিকদার আমিনুল হকের বৈশিষ্ট্য নয়। এক প্রসন্ন বিহ্বলতা যেন তাকে বলতে প্ররোচিত করে। কবিতায় তার ভাষা মৃদুশান্তঅচঞ্চলসাবলীলও পরিকল্পিত। এক অনুচ্চ অন্তর্লীন ও দূরাভিসারী সঙ্গীতের প্রবাহ একে ঘিরে আছে। বিষয়কে প্রতীকায়িত করে এক প্রলুব্ধকর অস্পষ্টতা তৈরির প্রবণতা এই বইয়ের কবিতায় আমরা পাবো। কিন্তু সিকদারের আত্মমুদ্রাও এখানে অঙ্কিত হয়ে গেছে। শিল্প-তীর্থের উদ্দেশে এক আভিযাত্রা বা সেই অভিযাত্রার বয়ান এই কাব্যযা অঙ্গীভূত করে নিয়েছে জীবন কিংবা নারীর শিল্প-সারার্থ উন্মোচনের দায়অস্পষ্ট করে হলেও— মানুষের প্রতি অঙ্গীকার। এবার পাঠ করতে পারি এই অংশটি :
মানুষকে কোনো কথাই বলা হয়নিতবু সে জেনে নিয়েছে পাথরের ভাষাওজন করতে শিখেছে ব্রোঞ্জ আর নিরাবরণ নারীর বিশালতাঝাঁঝালো রূপসীর পশ্চাদেশের বিশালতা কোনো সমুদ্রও নয়তবুও সেখানে নোঙরের জন্য চঞ্চল ইচ্ছাই শব্দগুচ্ছের মর্যাদা পায়না হয় নারীতোমাকেই,শেষবার অভিবাদন জানাবো
(
 পদদলিত শিরস্ত্রাণদূরের কার্ণিশ)
   পরবর্তী সকল কাব্যেবিশেষত টানা গদ্যের কাব্য দুটিতে নারীর প্রতিঅভিবাদন রচিত হয়েছে অকুণ্ঠ ভাষায়। নারী নামক বন্দরে নোঙরের আর্তিই এর অন্যতম মুখ্য প্রবণতা। দূরের কার্নিশে প্রতীকায়িত জলও পরবর্তীকালে ফিরে এসেছে বার বার কিন্তু অন্যরূপে। তার মৃত্যুর পরে আজ আমি আমরণ সমুদ্রের দিকে যাবো’ এই প্রত্যয়ী উচ্চারণের গভীরতা আমরা অনুভব করতে পারি। সিকদার আমিনুল হকের টানা গদ্যের বিশিষ্টতা ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে গেলে আমাদের তার পরবর্তী কাব্য দুটিসতত ডানার মানুষ ও বাতাসের সঙ্গে আলাপ পাঠ করতে হবে অভিনিবেশের সাথেযেখানে কবি হয়ে উঠেছেন আরও অভিজ্ঞপ্রাজ্ঞ ওল্যভেদী। কবি হয়ে উঠেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এটি আসলে তার কাব্যের একটিস্বতন্ত্র পর্ব। সতত ডানার মানুষ  থেকে উদ্ধৃত করা যাক :
১.    ….আজ আমি প্রসঙ্গত নারীর কথাই বলবোআমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছেএখন আমি মানুষের লালসা নিয়েও ঠাট্টা করতে পারিবয়স হলো সেই উটবালুর অন্ধকার ঝড়ের মধ্যেও যে তার মালিকের পাগড়ির রঙ ঠিকঠিক চিনতে পারেঅথচ উটকে দেখতে পায় না কেউ
 
২.    
মৃত্যু সেই পরিচিত তরবারিযা আমাদের হাত থেকে স্বজনেরা নেয়ার মুহূর্তেও আমরা যার ধারালো যন্ত্রণার কথা বিস্মৃত হয়ে আকাশ কিংবা জরির মতো কাজ করা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকিএবং তার ছায়া ও ভীতি অপসৃত হওয়ার আগেই রূপসী নারীর সঙ্গম স্পৃহার দিকে শরীরে জন্তুর গন্ধ নিয়ে এগিয়ে যাই
 
৩.    
শেষ কথা স্বৈরশাসক আর দুর্ধর্ষ বর্বর বিজয়ী সম্রাটের মুখেই মানায়;যাঁদের দম্ভ আর শক্তির একটি করুণ ডানা মৃত পতঙ্গের মতো সমুদ্রের বালির ওপর অতি নির্বাসনে পড়ে থাকে
   ওপরের তিনটি উদ্ধৃতিতেই একটি বিশেষ কৌশলযা তার বৈশিষ্ট্যচোখে পড়ে আমাদের। সেটি হচ্ছেকবি যখন উপমার প্রয়োগ করেন তখন সেটিকে প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে আরও দূর পর্যন্ত প্রসারিত করে দিতে চান। উপমার জন্য তিনি নিতে পছন্দ করেন সাধারণত কোনো বস্তু  বা বিষয় নয়বস্তু বা বিষয়ের ধারণা ও তার পরিপার্শ্ব। আবার বস্তুকে গ্রহণ করলেও দেখা যাবে নিচ্ছেন ওই বস্তুটির কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত অবস্থা। ফলে সেটি হয় একটি পুরো বাক্য। উপমা-চিত্রকল্প কি বর্ণনার ক্ষেত্রে পাঠকের অভ্যস্ততা যেখানে থামতে চায়তিনি সেখানে শ্বাস ফেলেন মাত্রকিন্তু চলে যান আরও দূরেপাঠকের ভাবনা কে ছাড়িয়েপ্রসঙ্গকে বিশদ করে তোলেন। প্রথম উদ্ধৃতিতে বয়সকে তিনি তুলনা করলেন উটের সাথেযে উট মরু ঝড়েও মালিককে চিনতে ভুল করে না। এখানেই পাঠকের প্রত্যাশা সমাপ্ত। কিন্তু তিনি এখানে না থেমে এগিয়ে গেলেন আরও। ফলে উপমাটি বক্তব্যকে জোরালো করেই সমাপ্ত হয় নিবক্তব্য-বিষয়ের অংশ হয়ে গেছে। তার বাগভঙ্গি এখানে খুবই উন্মেচন-প্রিয়। তার এই কবিতাগুলো আসলে নারীকে সামনে রেখে নিজেরই উন্মোচন যেন যা-কিছুরই উন্মোচন তিনি করুন না কেন। ফলে তার উচ্চারণগুলো অনিবার্য সত্যের মহত্ত্ব পেয়ে যায়। কোথাও কোথাও রচনা করে ফেলেন আপ্তবাক্য। কিংবা দেখতে পাই কখনো স্থির ও নিশ্চয়াত্মক ধর্মগ্রন্থীয় বাকপ্রতিমার অনুকরণযেন সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে এক দেবপ্রতিম কবিসত্তা অমোঘ উচ্চারণের প্রয়সকরছে। অনিশ্চয়তার কম্পন যা সহজে সংক্রামকতা তাকে আলোড়িত করে কম। বিস্ময়ের অধ্যায় যেন অবসিত। জীবন সম্পর্কিত প্রশান্ত দার্শনিকতা এই গদ্যের অঙ্গীভূত ; এবং এই সেই শক্তিযার ফলে চেনা হলেও তার ভাষাকে এতো আলাদা স্বাদের মনে হয়। টানা গদ্য কবিতার চাল এমন হওয়া উচিত বলে কি তিনি মনে করতেনএবং এ জন্যই তরুণদের টানা গদ্য না লিখবার পরামর্শ দিয়েছিলেন?
    পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ বাতাসের সঙ্গে আলাপে দেখতে পাচ্ছি টানা গদ্যে আরওকিছু কৃ-কৌশল তিনি ব্যবহার করছেন। কোথাও কোথাও টুকরো আখ্যান তিনি ব্যবহার করছেন আগের টানা গদ্যে যা-ছিলো আরও ফ্র্যাগমেন্টেডতবে কবিতার ভেতরে বিশেষভাবে আখ্যান বা গল্প ব্যবহার তার অভিপ্রেত নয়অনেকগুলো কৌশলের এটি একটি মাত্র। যেহেতু অনেকটা কনফেশনাল ধরনে তিনি কথা বলেনবিশেষত এই কবিতাগুলোতে সেহেতু আত্মজীবনীর নানান বিচূর্ণ অংশ বিভিন্ন মুখোশে প্রবেশ করেছে। নিচের টানা গদ্য কবিতাটি পড়া যাক :
একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছিলো শাদা তুষারে ঢাকা পিটার্সবুর্গের রাস্তাঘাটের ব্যবহার তখন কম রাত্রি ছিলো আলোকিত ক টেবিলে জ্বলে যাচ্ছে মোমের বাতি
 এই স্বপ্নটা আমি একদিন নয়দু-দিন নয়তিনদিন দেখলাম
 গাড়ি যাচ্ছে ঘণ্টা বাজছে গাড়িওয়ালার হাতে ভেতরে জিভাগো ছিলেন না। (উপন্যাস কার প্রতিবিম্ব?) ছিলেন পাস্তেরনাক নিজে কবি লেখক মৃত্যু ভয়ে চিন্তিত প্রেমিক এবং যাঁর পশমের ওভার কোটের ভেতরে লুকানো থাকতো বাচ্চাদের কান্না !
 চতুর্থ দিন আবিষ্কার করলামস্বপ্নটা আর কিছুই নয় একটা ক্রোধ সেই ক্রোধটা হলো আমি আরও একবার এক মৌলিক দীর্ঘাঙ্গীর প্রেমে পড়েছি
                                                              (নতুন প্রেমবাতাসের সঙ্গে আলাপ)
 
   আমরা লক্ষ করলে পাবো
 এখানে কবি একটি আখ্যান ব্যবহার করছেন। এবং অন্যদিকে এর বাক্যগুলো বেশ হ্রস্ব। পাঠকের দ্রুত মনে পড়বে তার ছন্দে লেখা কবিতাগুলোযেখানে হ্রস্ব বাক্যে এগোনোর কৌশল তার। আসলে এটা ঠিক আখ্যান বর্ণনা নয়সিকদার তা চানও না। তিনি আখ্যানের প্রসঙ্গ থেকে পৌঁছুতে চান অন্য কোনো ডাইমেনশনে। যেমন,উদ্ধৃত কবিতাটির শেষে যে অভিনবত্বের চমক আমরা পাইতা মহ শিল্পের অন্তর্গত। ডাক্তার জিভাগো উপন্যাসের আবহকে স্বপ্নের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে তিনি ঔপন্যাসিক ও তার সৃষ্ট চরিত্রকে এক সমান্তরালে এনেযে চমকারিত্ব ও ছক তৈরি করলেন এতণপরমুহূর্তে তাকে নিয়ে গেলেন অভাবনীয় এক উচ্চতায়। এমনিভাবে আমাদের মনে পড়তে পারেগালিব স্ট্রিটে কবিতাটিযেখানে কলকাতার গালিব স্ট্রিটে টানা-রিকশার আরোহী এক এংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের ঘরে ফেরার ঘটনাই হয়ে উঠেছে রহস্যায়িত। পেছনের পট তৈরি করে দিয়েছে জ্যোস্নাআকাশে এক গোলাকার বোকা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে সব। আমরা দেখি তখনমেয়েটির আত্মীয়স্বজনেরা ক্রমেই দূর-দূরান্তের দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে যায়আর বর্তমানকালে অতীতের অধিক্রমণ শুরু হয়ে যায়
 
এই হ্রস্ব কালো স্কার্ট
এই বিষন্নতাএই পূর্ণচাঁদ আর ধূমপানের কান্তি গালিব স্ট্রিটটাকে সোজা তুলে নিয়ে গেলো হারুনুর রশীদের বাগদাদে!
এভাবে ঘোর ও রাহসিকতা তৈরি করা তার একটি কৌশল বটে। সবক্ষেত্রে যে তিনি এটি করেন এমন নয়। সে যাকতাকে নিয়ে একটি অভিযোগ চালু আছে। তিনি কবিতায় বিদেশী আবহ আনেন। আসলে সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় তার পঠন-অভিজ্ঞতার ছাপ আছে। আমার মনে হয় তা ইতিবাচক অর্থেই। তিনি তার প্রিয় সব কবি কি লেখককে নিয়েকবিতা লিখেছেন। তাদের যাতনা-যাপিত জীবন কি দর্শনকে কবিতায় তাদের প্রতি স থেকে নানানভাবে এনেছেন। সম্ভবত তিনিই বিভিন্ন লেখক-শিল্পীকে নিয়ে সর্বাধিক কবিতা লিখেছেন। অন্যদিকেযে শ্রেণীর জীবন তার লেখার প্রধান উপজীব্যতার সঙ্গে  বিদেশী আবহের বিষয়টি মানিয়ে যায়। অবশ্য অনুসঙ্গ ধরে ধরে দেখলেও বিদেশী আবহের সত্যতা মিলবে। কিন্তু এ-ও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যেসিকদার আমিনুল হক যে কৌশলে তার বাক্যগুলো নির্মাণ করেন ও বিন্যস্ত করেনওইধারণার পেছনে তারও হাত কম নয়। তার বাক্যগুলো সাধারণত ইংরেজি কমপ্লেক্স বাক্যের আদলে নির্মিত। এতে থাকে যেযারযাযেই-সেই ইত্যাদি সর্বনামের সুপ্রচুর ব্যবহার। কখনো দেখি তিনি এসব বাক্যের অধীন উপবাক্যটিকে আলাদা একটি বাক্যের মর্যাদা দিয়ে শুরু করছেনযা শুরুই হচ্ছে ওই সর্বনামগুলো দিয়ে। কিংবা দেখা গেল একটা বাক্য শুরু হচ্ছে এবং-জাতীয় কোনো অব্যয় দিয়ে। কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ উপমা-চিত্রকল্প-প্রতীক ব্যবহারের বিশেষত্বের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া বিশেষণ ব্যবহারের কৌশলে তার অভিনবত্ব বা মৌলিকতা আমাদের যে বিস্ময়ের মধ্যে ফ্যালে তাতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই বিশেষত্ব সম্বন্ধপদ ব্যবহার পর্যন্ত প্রসারিত। রবীন্দ্রনাথ যখন তার একটি গানে (সখি ভাবনা কাহারে বলে) লিখলেনবিশদ জোছনাকুসুম কোমল তখনপুরো গান বাকবিতাটিতেই জ্যোস্না প্লাবিত হলোকুসুম যেন আরও কোমল হয়ে উঠলো প্রথাগত বিশেষণ ব্যবহার সত্ত্বেও এবং বাংলাভাষায় বিশেষণ প্রয়োগের এক নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। শব্দের প্রতি তার সজাগদৃষ্টি পাঠক তাকে পাঠ করা মাত্রই পাবেন। কবির অহঙ্কারী বচন উদ্ধৃত করি এবার (অবশ্য তিনি কখনোই বিনীত বা নম্র ননবরং দৃপ্ত ও সজাগ) :
সব শব্দের জয় , গন্ধ আর মতার চিত্র আমি জানি ভ্রমণের হাল্কা চোখ নিয়ে আমি আসিনি আমার চোখ প্রাচ্য দেশের এর ঠাণ্ডা গভীরতা সেই রুমালের মতো ; বাক্স খুললেই যার গুমোট গন্ধ আর পরিণত ভাঁজ ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে
                                                (যে-সব শব্দ আমি জানিবাতাসের সঙ্গে আলাপ) 

সিকদার আমিনুল হকের দুটি ইন্দ্রিয়ের তীব্রতা পাঠকের অনুভবকে এড়াবে না। তা হচ্ছেদৃষ্টি ও শ্রুতি।
টানা গদ্য কবিতার আরেকটি চমকার বইয়ের খোঁজ পাঠকের মনোযোগের সামনে নিবেদিত হয়েছে এর পরে এটি গৌতম বসুর রসাতল। সান্দ্র মন্থরতার ভেতরে ভেতরে এক অনির্দেশ্য উদ্বেগ ও আর্তি অনুপ্রবেশ করে তার কবিতায়দেখা দেয় চঞ্চলতা। উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে :
হারিয়ে যাওয়ার কথাপৃষ্ঠাগুলি হারিয়েনষ্ট হয়ে যাওয়ারই কথা ; যেভাবে পাহাড়ের কোল থেকে বিশল্যকরণী চিরতরে হারিয়ে গেছে অশ্রুময়ী নামটি প্রখর তাপে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেইভাবে তার কাছে গিয়ে বসতে তাই আর মন সরে না ; দূর থেকে দেখিদালান থেকে রোদ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেআমাদের বেঞ্চির উপরে একটা জলের কেটলিহাতপাখা একটা,আর ফিরে-ফিরে আসছে বাস্পের চেয়েও সূক্ষ্ম ভগ্ন সেই পঙ্ক্তিমালাসেই প্রজ্জ্বলিত উক্তির অবশেষ
 দিব্যোন্মাদ বাক্যসকলজাগো বলোআমরা হেঁটে এসেছি ধ্বংসের দিকে বেঁকে যাওয়া তমসাবৃত পথটিতেফিরে এসেছিনির্মল ও সর্বশান্ত হয়ে ফিরে এসেছি 
(
 রক্ষারসাতল)
    সময় ও অনুভূতির শূন্য পরিসরের দিকে তাকিয়ে এই উচ্চারণ। এর গদ্যের মধ্যে
 আমরা একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লিপিকা ও বিচিত্র প্রবন্ধের দূরাগত সুর টের পাইমনে জাগতে চায় শিশুতীর্থের বাগভঙ্গিও। কিন্তু যেহেতু মোহিত হতে সমস্যা হয় নাবোঝা যায় কবির নিজস্বতা মুদ্রিত আছে দৃষ্টিভঙ্গিতে ও গদ্যের নির্মিতিতে।


   এ ছাড়া সমসময়ের অনেক কবিই টানা গদ্য কবিতায় আত্মস্বার মুদ্রিত করতে
 পেরেছেনহয়তো একক কোনো গ্রন্থ লেখেন নি। এ ক্ষেত্রে  উপল কুমার বসুর নাম আসবে টানা গদ্যের কাঠামোতে ছন্দের চাল ভরে দেবার জন্য। দেখা যাবে একটি বাক্য ঢুকে যাচ্ছে পরবর্তী বাক্যেপরের বাক্যটির কাঠামো চুরমার করে সেটি থামছে। একটি বড়সর কবিতা একটিমাত্র দাড়িতে শেষ হচ্ছে। কবিতায় ম্যাডনেস ঢুকিয়ে দেবার প্রয়াস যেন।
এর সাথে সাথে কবি রণজি
  দাশের কথা বলা প্রয়োজন। তার টানা গদ্য কবিতাতে নিজস্বতা মুদ্রিত হতে পেরেছে যখন তিনি আখ্যানকে ব্যবহার করেন। একটা সামান্য প্রসঙ্গেও অসীমের ব্যঞ্জনা ও ব্যাপ্তি আনাই তার ধরন। অনেক সময় দেখি কবিতা নেহা প্রবন্ধের ভঙ্গিতে শুরু হচ্ছেকিংবা একটি আখ্যানকে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে অনুসরণ করতে করতে এগুচ্ছে,কিন্তু হঠা পাঠককে চমকে দিয়ে বুদ্ধিকে পার হয়ে এটি এমন জায়গাতে উপনীত হয় যেখানে ছোঁয়া লাগে অসামান্যের।
    সাম্প্রতিক কালে টানা গদ্য কবিতা বিশ্ব জুড়েই একটি জনপ্রিয় মাধ্যম
 ,বাংলাদেশেও। নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে এখন বেদম লেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নবীনদের সাবধান হওয়া ভালো। কেননা যে ছন্দ-দতা বাঞ্ছনীয়তার অভাবে তাদের টানা গদ্যের অভিযান ব্যর্থ হবে মেরুর দেখা পাবার বহু আগেই মরু-ঝড়ে নাহলে তুষার পাতে নিহত হবে কবিতা। শিল্প-সফল কবিতার কৃ-কৌশল আয়ত্ত করার আগেছন্দে পারঙ্গমতা আসার আগে এর চেষ্টা না-করা ভালো। রবার্ট ফ্রস্টকে আবার স্মরণ করিনেট ছাড়া টেনিস তো কোনো টেনিসই নয়কিন্তু যে টেনিসে মাস্টার সে-ই নেট ছাড়া টেনিস খেলবার সাহস দেখাতে পারে। সিকদার আমিনুল হক সম্ভবতএজন্যই বয়স চল্লিশের আগে টানা গদ্য কবিতা লিখতে নিষেধ করেছেন।

No comments:

Post a Comment