Thursday, March 28, 2019

নোবেল নিয়ে লবিং করা উচিত

– না জি ব ও য়া দু দ

পৃথিবীতে অনেক ধরনের পুরস্কার আছে। কিন্তু নোবেলের মতো এত মর্যাদাবান পুরস্কার আর নেই। যেকোনো বড় মানুষের মনে এই পুরস্কার পাওয়ার একটা প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা থাকেই থাকে, তা তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করুন বা না-ই করুন। এরজন্য বছরের পর বছর ধরে প্রচার-প্রোপাগান্ডাও কম হয় না। মিডিয়া তো আছেই। যার যাকে পছন্দ তাকে তুলে ধরার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকে তাদের, বারবার তাদের নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলে অব্যাহতভাবে। সেসব দেখে-পড়ে সাধারণভাবে কারো সন্দেহ হবে না যে, এগুলো আসলে প্রচার-প্রেপাগান্ডা, তা এতটাই ছদ্মবেশী। এসব কারণে নোবেল পুরস্কার নিয়ে আগ্রহের যেমন শেষ নেই, সমালোচনাও কম নয়। যা-ই হোক, প্রতিবছর সেপ্টেম্বর এলেই নোবেল পুরস্কার নিয়ে তোড়জোর বেড়ে যায়, ভেতরে ভেতরে শুরু হয় নানারকম লবিং-গ্রুপিং। আর অক্টোবর পড়লেই শুরু হয় প্রকাশ্য আলোচনা-পর্যালোচনা। কারণ, অক্টোবরের প্রথম দশকের মধ্যেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।

নোবেলের জন্ম

ডিনামাইট আবিষ্কারক সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল (১৮০৫-৮৯) এই পুরস্কারের ব্যবস্থা করে যান। তার পেছনে একটা মর্মান্তিক ইতিহাস আছে। ডিনামাইট আবিষ্কার তাঁকে বিপুল বৈভবের মালিক বানায়। ১৮৮৮ সালে তাঁর ভাই লুদভিগ কান ভ্রমণের সময় মারা যান। সেসময় তাৎক্ষণিকভাবে রটে যায় যে, আলফ্রেড নোবেল মারা গেছেন। একটি ফরাসি কাগজে ‘মৃতু্যর বণিকের মৃতু্য’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘ড. আলফ্রেড নোবেল, যিনি ধনী হয়েছেন আগের চেয়ে আরো দ্রুত বেশি বেশি মানুষ হত্যা করার হাতিয়ার বানিয়ে, তিনি গতকাল মারা গেছেন।’ এটা পড়ে নোবেল খুব দুঃখ পান, তিনি এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে, তাঁর সত্যিকারের মৃতু্যর পর লোকে তাঁকে এইভাবেই মূল্যায়ন করবে। এই ভাবনা তাঁকে তাঁর সম্পদ কোনো ভালো কাজে ব্যবহার করতে উৎসাহ জোগায়। ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি তাঁর সকল সম্পদ উইল করে দেন। এই উইল অনুযায়ী প্রথমে ফিজিক্যাল সায়েন্স, রসায়ন ও মেডিক্যাল সায়েন্স/ফিজিওলজি, এই তিন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার চালু করা হয়। পরবর্তীকালে সাহিত্য, অর্থনীতি ও শান্তি ক্যাটাগরিতেও পুরস্কার চালু করা হয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের চিন্তক ছিলেন এরিক লিন্ডবার্গ। ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দিকে বহুকাল ধরে বিশেষ একটি বইয়ের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হতো। এখন অবশ্য লেখকের সামগ্রিক অবদানের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। ‘আর্থিক সংকট’ ও ‘যোগ্য লোকের অভাব’-এ ১৯১৪, ১৯১৮, ১৯৩৫, ১৯৪০, ১৯৪১, ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।

নোবেল নিয়ে বিতর্ক

নোবেল পুরস্কার নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। প্রথম থেকেই যে বিতর্কের শুরু সেটা হলো, আলফ্রেড নোবেল যে লক্ষ্যে পুরস্কার দিতে বলেছেন, তা মান্য করা হচ্ছে কি-না। এটি অবশ্য ধোপে টেকেনি, সে বিতর্ক এখন আর কেউ করে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, কিসের ভিত্তিতে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি নেই। হেনরিক ইবসেন, লিও টলস্টয়, ফ্রাঞ্জ কাফকা, জেমস জয়েস, নবোকভের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরা এই পুরস্কার পাননি। কেন পাননি, তার কোনো সন্তোষজনক জবাব নোবেল কমিটি দিতে পারেনি। অথচ এমন নোবেল লরিয়েটের সংখ্যা কম নয়, যাদের নাম বর্তমান বিশ্ব ভুলেই গেছে। সুতরাং অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সে কারণে এ বিতর্ক এখনো চলছে। ধারণা করা হয়, ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ এ ক্ষেত্রে প্রায়শই প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। কারণ, দেখা গেছে নোবেল লরিয়েটদের অধিকাংশই ইউরোপ-আমেরিকার লোক। এর বাইরের যারা নোবেল পেয়েছেন, বেশিরভাগ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার, তারাও কোনো-না-কোনোভাবে ইউরোপ-আমেরিকা সংশিস্নষ্ট। তারপরও, একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সুইডিশ অ্যাকাডেমি একেবারে যাকে-তাকে কখনো এই পুরস্কার দেয়নি।

কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন বলে অধিকাংশমহল যাদের নাম নিয়ে আলোচনা করেছে, বাস্তবে তারা তা পাননি। যেমন, গতবছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আমেরিকান কথাশিল্পী ফিলিপ রথ, সিরীয় কবি অ্যাডোনিস (আলী আহমদ সাঈদ), ইসরাইলি লেখক অ্যামোস ওজ, আমেরিকান কথাশিল্পী জয়েস ক্যারল ওয়েটস, ক্যানাডিয়ান কথাশিল্পী মার্গারেট অ্যাটউড ও এলিস মনরো, জাপানি কথাশিল্পী হারুকি মুরাকামি, কোরীয় কবি কো উন প্রমুখ। বিশ্ববিখ্যাত নাইজেরীয় লেখক চিনোয়া আচেবে, কেনীয় নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, ইতালীয় মিলান কুন্ডেরা, পেরুর মারিয়ো ভার্গাস য়োসা প্রমুখের নামও আলোচনায় ছিল। জার্মানির হারতা মুলারের নাম তেমন একটা আলোচিত হয়নি। কিন্তু দেখা গেল, তিনিই পুরস্কার পেলেন। এবছরও অনেকটা সেরকমই হয়েছে। এবছরও এসব নামই আলোচনার শীর্ষে ছিল। টপ ফেভারিট ছিলেন সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রোমার। ভার্গাস য়োসার নাম আলেচিত হলেও তিনি ফেভারিটদের তালিকায় ছিলেন না। কিন্তু তিনিই পুরস্কার পেলেন। ভার্গাস য়োসার যোগ্যতা নিয়ে কেউ কথা তোলেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানও এর পেছনে কাজ করেছে কি-না। তিনি প্রথমজীবনে কমিউনিস্ট ছিলেন। কিন্তু পরে উদারনৈতিক গণতন্ত্রী এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির এতটাই সোচ্চার প্রবক্তা বনে গিয়েছিলেন যে, তিনি এমনকি ১৯৯০ সালে এই নীতি প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে পেরুর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে নামেন; অবশ্য হেরে গিয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়েছেন। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবং ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের কঠোর সমালোচক তিনি। প্রায় বৎসরাধিককাল ধরে তিনি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বেড়াচ্ছেন; প্রশ্নটা উঠেছে এসব কারণেই।

এতদিন অভিযোগ করা হচ্ছিল, নোবেলকমিটি কিছুটা বামঘেঁষা হয়ে উঠেছে। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে নিষ্ক্রিয়, বা বামপন্থার প্রতি কিছুটা বিরক্ত, এরকম লেখকদের গত কয়েকবছর ধরে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছিল। সে অভিযোগ হয়তো-বা ভার্গাস য়োসার ক্ষেত্রেও তোলা যায়, যদিও বাম রাজনীতিকে তিনি কেবল প্রত্যাখ্যানই করেননি; এর বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থানও নিয়েছেন।

আমেরিকানদের ক্ষোভ

নোবেল পুরস্কার নিয়ে আমেরিকানরা এবার বেশ উত্তেজিত এবং ক্ষুব্ধ। তাদের ধারণা, সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাদের ঠিক-ঠিক মূল্যায়ন করছে না। ১৯৯৩ সালে টনি মরিসনের পর আর কোনো আমেরিকান লেখক নোবেল পুরস্কার পাননি। বলতে কি, ১৯৯৪ সালে জাপানি লেখক কেনজাবুরো ওয়ে এবং ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জে এম কোয়েটজি বাদে ইউরোপিয়ানরাই ১৬ বছরধরে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আসছেন। সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে অতীতেও ইউরোপিয়ানদেরই প্রাধান্য ছিল। হিসাব নিয়ে দেখা যাচ্ছে, ১৯০১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার চালু হওয়ার পর থেকে ইউরোপিয়ানরা এ পুরস্কার পেয়েছেন ৭৮ বার, আমেরিকানরা ১০ বার, ল্যাটিন আমেরিকানরা ৬ বার, আফ্রিকানরা ৪ বার, এশিয়ানরা ৩ বার এবং অস্ট্রেলিয়ানরা ১ বার। সম্প্রতি, এবারের নোবেল ঘোষণার কিছু আগে, সুইডিশ অ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব হোরেস এংদাল পরিষ্কার ভাষায় মার্কিনদের অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব ভাষাতেই ভালো সাহিত্য রচিত হচ্ছে, কিন্তু ইউরোপই এখনো সাহিত্যের রাজধানী; আমেরিকা নয়।’ এতে আমেরিকানরা আরো ক্ষেপেছে। তাদের কেউ কেউ তো এংদালের কাছে আমেরিকান লেখকদের বইয়ের তালিকা; এমনকি বাছাই-করা বই পাঠানোরও পরামর্শ দিয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন দ্য নিউ ইয়র্কারের সম্পাদক ডেভিড রেমনিক এবং ইউএস ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হ্যারল্ড অজেনব্রম। তাঁদের মতো আরো অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এবারও বোধ হয় আমেরিকান কেউ নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন না। হয়েছেও তা-ই। তবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো একটা ব্যাপার বোধ হয় ঘটেছে। ভার্গাস য়োসা পেরুর সন্তান, অর্থাৎ ল্যাটিন আমেরিকান; সে-ও একরকম আমেরিকানই বটে! তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমেরিকার বাসিন্দা; যদিও অস্থায়ী। অবশ্য এর অন্যদিকও আছে। ভার্গাস য়োসা লেখেন স্প্যানিশ ভাষায়, স্পেনের আইনানুগ নাগরিকও বটে। সে বিবেচনায় তাঁর গায়ে ইউরোপের গন্ধ লেগেই থাকছে।

বাঙালিদের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ছে না

১৯১৩ সালে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে। যা-ই হোক, সেই থেকে বাঙালিরা নোবেল পুরস্কার নিয়ে কম হইচই করছে না। আজকাল খবর হিসেবে মিডিয়াতে নোবেলবিজয়ীর গুণকীর্তন তো হয়ই; বিশেষত খবরের কাগজগুলো তাদের সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতা ভরে তোলে নোবেলবিজয়ীদের নানা ধরনের বিষয়-আশয় দিয়ে। এই ধারা থেমে থেমে চলে অন্তত পরবর্তী বছরের নোবেলবিজয়ীদের নাম ঘোষণা পর্যন্ত। কিন্তু কাউকে এ নিয়ে ভাবতে দেখা গেল না, রবীন্দ্রনাথের পর বাঙালিরা কেন সাহিত্যে নোবেল পাচ্ছেন না_এ নিয়ে লেখক-পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে এবং নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে আমার যেটা উপলব্ধি হয়েছে, সেটা হলো, বাংলাভাষার অনেক সাহিত্যিকেরই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা ছিল এবং আছে। কয়েকটা নাম উচ্চারণ করা যায় নির্ভয়ে, দ্বিধাহীন চিত্তে_কবিদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ; কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ তাহলে পাননি কেন? সম্ভবত এর প্রধান কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলা বইয়ের অনুবাদের অভাব। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ হয় না বললেই চলে। যা দু-একটা হয়, তার অনুবাদের মান বাজার-চলতিরও নিচে। তাছাড়া সে অনুবাদ প্রকাশিত হয় সাধারণত দেশেই; ইউরোপ-আমেরিকাতে নয়। আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে বাংলাভাষার সাহিত্যিকদের কি ব্যক্তিগত পর্যায়ে, কি সাংগঠনিক পর্যায়ে যোগাযোগও অত্যন্ত ক্ষীণ। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের কথা না বলাই ভালো। আরেকটি কথাও স্বীকার না-করা উচিত হবে না বলে মনে করি। সেটা হলো, আমাদের সাহিত্যের বিষয়, আঙ্গিক ও জীবনবোধ পশ্চিম থেকে ধার করা। সেটা তাদের কাছে অনুকরণ এবং চর্বিতচর্বন বলে গণ্য হয়। আফ্রিকান ও ল্যাটিন আমেরিকানরা পশ্চিমের আঙ্গিক গ্রহণ করলেও বিষয় ও জীবনবোধের নিজস্বতা নির্মাণ করেছে। সে কারণে সেটা পশ্চিমের কাছে নতুন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। তাদের আরেকটা সুবিধা হলো, তারা লেখেন মূলত ইউরোপ-আমেরিকার কোনো ভাষায়, বিশেষত স্প্যানিশ, ফরাসি ও ইংরেজিতে। সে কারণে তারা সরাসরি পাশ্চাত্যের বাজারে ঢুকতে পারেন। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের একটা বড় অংশ মূলত, বিভিন্ন সূত্রে, ইউরোপ-আমেরিকারই বাসিন্দা; সেটাও তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। বাংলাসাহিত্যের প্রধান লেখকরা এই সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত। ইউরোপ-আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এজন্য কম দায়ী নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও একথা সবাই জানে যে, নোবেল পুরস্কারের পেছনে সূক্ষ্ম রাজনীতি সবসময়ই ক্রিয়াশীল। নানা কারণে বাংলাভাষীরা ইউরোপ-আমেরিকার এই রাজনীতির কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফলে, বাংলাসাহিত্যের লেখকরা তাদের আগ্রহ বা সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত। সুতরাং, মনে হয়, বাংলাভাষী সাহিত্যিকদের জন্য আপাতত কিছুকাল নোবেল পুরস্কার শিকেয় তোলাই থাকছে।

নোবেল নিয়ে লবিং করা উচিত

এইভাবে বললে কথাটা খারাপ শোনায়। বাস্তবে আমি বলতে চাচ্ছি, নোবেল পাওয়াটাই একমাত্র ব্যাপার নয়; আমাদের এমন সব প্রচেষ্টা নেয়া উচিত, যাতে আমাদের সাহিত্য বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়ে, আলোচিত হয়। এজন্য নোবেল লরিয়েটসহ বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনের বড় ব্যক্তিত্বদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ দেশে নিয়ে এসে আমাদের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ তৈরি করা দরকার। ভালো অনুবাদকদের দিয়ে আমাদের বাছাই-করা ভালো ভালো বইয়ের অনুবাদ করিয়ে নেওয়া এবং সেসব বই আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সেসব অনূদিত বই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় লেখক ও সমালোচকদের কাছে পাঠাতে হবে। তাঁদের দিয়ে বইগুলোর ওপর আলোচনা লিখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন অর্থ। প্রতিবছর খেলাধুলার পেছনে যে পরিমাণ সরকারি-বেসরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়, তার চারভাগের একভাগ এই কাজে বরাদ্দ করলেই যথেষ্ট। এভাবে এক-দেড় দশকের মধ্যেই বাংলাসাহিত্য ও সাহিত্যিকদের বিশ্ববাজারে অন্তভর্ুক্ত করানো সম্ভব বলে মনে করি; চাই কেবল উদ্যোগ। প্রথম উদ্যোগ সরকারের দিক থেকে প্রত্যাশা করাই সঙ্গত হবে।

Wednesday, March 27, 2019

বাংলা কবিতা বিষয়ে আমার ওয়েবসাইট ও ব্লগ সমূহের এড্রেস এবং অন্যান্য


আমার তৈরী করা বাংলা কবিতা বিষয়ে ওয়েবসাইট ও ব্লগ সমূহের এড্রেস নীচে দেয়া হল: ১) www.banglapoetry.xyz ২) http://mypoembd.blogspot.com ৩)  http://haikuall.blogspot.com ৪) http://pablonerudabd.blogspot.com ৫) http://banalatasenbd.blogspot.com ৬) https://banglapoembd.blogspot.com

বাংলা কবিতা ও সাহিত্য সম্পর্কিত বাছাইকৃত কিছু ওয়েবসাইট এখানে দেয়া হলো:  ১) http://utsanga.com২) www.natunekmatra.com৩) www.sahityacafe.com৪) https://pathchokro.com৫) http://raashprint.com, ৬) www.kaliokalam.com ৭) https://molakat.com । ডিরেক্টরী আকারে আরো বহু ওয়েবসাইট সম্পর্কে জানার জন্য এই ওয়েবসাইটের এই পেইজটি ব্রাউজ করুন:  Poem Links 

Tuesday, March 26, 2019

নীতি-কবিতা : বাংলা কবিতার হারিয়ে যাওয়া সম্পদ

- মু হা ম্মা দ হা বী বু ল্লা হ 


            এক সমাজব্যবস্থা থেকে অন্যতর ও উন্নততর সমাজব্যবস্থার দিকে অভিযাত্রা এবং কালো সভ্যতা থেকে ভালো সভ্যতা অভিমুখে যাত্রার জন্যই নানা কালপর্বে নৈতিক বাণী, লোকধর্ম, ধর্ম, দর্শন, দর্শনজাত রাজনৈতিক আদর্শ ও মতাদর্শের সৃষ্টি। যুগ-যুগান্তরে নীতির জন্ম হয় মানবসমাজ ও সমাজজীবনের অভিজ্ঞতার পরিণতি থেকে, পরিণতি থেকে অর্জিত শিক্ষার পথ ধরে। ব্যক্তির জন্ম হয় নীতির ওপর, কিছুটা বেড়েও ওঠে সে নীতির ওপর। কিন্তু পরে বিকশিত হওয়ার পথে, বিশেষ করে দ্বান্দ্বরক্তিম আধুনিক জীবনে নীতিকে বিশাল বাধা মনে করে। প্রতিটি মানুষের ভেতরে কোনো না কোনোভাবে, জীবনের কোনো না কোনো কালপর্বে, নীতিবোধ, নীতিভাবনা, নীতিগ্রহণ ও নীতিপ্রচারের তাড়না এবং প্রেরণা থাকে। নীতিবোধ ও নীতিভাবনা প্রত্যেক মানুষের ভেতর, বোধহয়, জীবিত ও জাগ্রত থাকে আজীবন। কিন্তু নীতিগ্রহণ ও নীতিপ্রচারের প্রবণতা থাকে না বেশিদিন। প্রত্যেক ব্যক্তির নীতিবোধ ও নীতিভাবনা শক্তিতে-স্বচ্ছতায় এক ও সমগোত্রীয় নয়। মানুষের মনের গভীর প্রকোষ্ঠে নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিকতাবোধ পথসঙ্গী হয়ে চলাচল করে। একটি সূক্ষ্ম-সুগভীর অধ্যাত্মবোধ ছাড়া শিল্পচর্চা হয়ে ওঠে না। বিশেষ করে ললিতকলার উপাসনা হয় না। কারণ, সূক্ষ্ম রসানুভূতির পথ ধরেই মানুষের মধ্যে শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস ও প্রেরণা জেগেছিল একদিন; এখনও জাগে; জাগবেও চিরদিন। ফলে শিল্পসাধককে—নিজের সঠিক পথটিতে চলার জন্য অধ্যাত্মসাধক হতেই হয়। আধ্যাত্মিকতার আদর্শ যে গ্রহণ করে না এবং অধ্যাত্মবোধ (ব্যাপকার্থে; কোনো বিশেষ ইজমের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়) যার ভেতর জাগ্রত হয়নি, তার জন্য ললিতকলা চর্চা করতে যাওয়া এক ধরনের কষ্টকল্পনা ও বিড়ম্বনা। কারণ জীবনকে বা পুরো জগতকে অধ্যাত্মভাব ও বোধ নিয়ে দেখলেই সবকিছুর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রসঘন সত্তা অনুভব করা যায়। আর এ সত্তাকে যিনি যত বেশি উপলব্ধি করতে পারেন, তিনি কথাস্রষ্টা হিসেবে তত বেশি সার্থক। এই নীতিবোধের কারণেই সমইজমের মানুষরাও একসময় পরস্পর পৃথক হয়ে যায়, ভিন্ন পথে ও মতে পা বাড়ায়। প্রত্যেকে চলে যে যার পথে। শুরু হয় তর্ক। নীতি-নৈতিকতাহীন জীবনের চেয়ে জড় হওয়াকে ভালো মনে করেছেন অনেকে। তাই বাহাদুর শাহ্ জাফরের কবিতায় অভিমান অভিনীত হয় এভাবে : ‘মানুষ হইয়া হ’ল না যখন মানুষের মত মন/ভাল হ’ত যদি হয়ে জড়মতি রহিতাম আমরণ’ (অনুবাদ : সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)। 

          কাব্যসাহিত্য বিষয়ে ও আঙ্গিকে বহুশাখায়িত। তার শাখাসমূহের অন্যতম হলো নীতি-কবিতা। আধুনিকতার দুর্দম দাপটে মানুষের জীবন ও জীবনের সবকিছু এখন সংজ্ঞাহীন-প্রজ্ঞাহীন। মানুষ আজ সংজ্ঞার ছকে ফেলে কোনো কিছুকে বুঝতে চেষ্টা করে না এবং বোঝানোর চেষ্টা করা হলে সে বিরক্ত হয়। তথাকথিত অচলায়তন বা বৃত্ত ভাঙার যুদ্ধে এখন সবাই মত্ত। সুতরাং নীতি-কবিতার তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও একাডেমিক সংজ্ঞার পথ ধরে না এগিয়েও আমরা বলতে পারি—গল্প, কাহিনী, কাহিনী-খণ্ড বা নিছক কলাশিল্পের মাধ্যমে কবি জ্ঞানগর্ভ নীতিকথা বা তত্ত্বকথা প্রচার করে থাকেন। এজাতীয় কবিতাকে নীতি-কবিতা বলা যায়। তবে জ্ঞানের কথা, নীতির কথা বা তত্ত্বকথা কাব্য-সুষমায় মণ্ডিত হতে হবে। তা না হলে এ ধরনের কবিতা ব্যর্থ হতে বাধ্য। নীতি-কবিতায় কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও পরোক্ষভাবে কিংবা রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে মানবসমাজের কল্যাণার্থে আদেশ-উপদেশ বা নীতিকথা প্রকাশিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, উপদেশকথা ও নীতিকথার বিবরণ মানেই কবিতা নয়। অসাধারণ বাণীবদ্ধ কথামালাও সবসময় কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। দেহসৌষ্ঠবের লাবণ্যের অন্তরালে প্রাণৈশ্বর্যপূর্ণ একটি আত্মাও থাকতে হয় কবিতায়। আত্মার প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যেই মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতার রমণীয়তা, রসময়তা ও রহস্যময়তার সৌন্দর্য। ব্যক্তি এবং সেই সূত্রে পুরো সমাজ নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নৈতিক কদাচারের সংশোধনের লক্ষ্যে অনুশাসনতুল্য পথনির্দেশক বাণী বা উপদেশকে বুকে নিয়ে এ জাতীয় কবিতার জন্ম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মগ্রন্থে মূল মর্ম আলোচনা করলে দেখা যাবে, বিশ্বের মানুষকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে, সর্বোপরি সুনাগরিক ও সভ্যরূপে গড়ে তোলার জন্য নবী-রাসুল, শ্রেষ্ঠ মনীষী ও মহাপুরুষদের বাণী, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শিক্ষণীয় কাহিনীর আদর্শ, সেই সঙ্গে সাধারণ নীতিগ্রন্থ ও প্রবাদ-প্রবচন প্রবল শক্তি ও মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। সেই সূত্র ধরে পরবর্তী যুগে নীতি-কবিতা বা উপদেশমূলক কবিতার উদ্ভব ও বিকাশ। ফলে কাব্যসাহিত্যের এই শাখাটির শক্তি উল্লখযোগ্যভাবে কার্যকর। তা না হলে প্রাচীন যুগ থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের সকল দেশে ও সাহিত্যের তার গৌরবদীপ্ত প্রচলন এবং ভূমিকা থাকত না। আজকে যে আমরা বাউল ও মরমী দানের প্রতি শিক্ষিত সমাজের কৌতূহল দেখতে পাই, তারও মূলে রয়েছে নীতি-কবিতা প্রচলনের ভূমিকা। 

           শিল্পের সংস্থিতি উপেক্ষা করলে মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারে না কোনো কবিতা। আর মানুষের কাছে পৌঁছুতে না পারলে কবিতা রচনা ব্যর্থ। পাঠকের মনে যদি কবিতা কিছু সঞ্চার না করে, তা হলে সে করবেটা কী? বলা হয়ে থাকে, পৌঁছানোর জিনিসটা কেবলই রূপনির্ভর। কিন্তু ভুললে চলবে না, রূপেরও তো একটা ঈপ্সিত ছাপ বা ভাব থাকে, যা কবি এঁকে দিতে চান পাঠককুলের হৃদয়-গভীরে। সেটি কি একরকম বোঝানোর কাজ নয়? ভাবা বা ছাপ যা কবি এঁকে দিতে চান, সেটা অবশ্যি একান্ত কবিরই; পাঠক যদি ঠিক তা ধরতে না পারেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু পাঠকরা যদি আকৃষ্ট ও প্রাণিত না হন, তাদের বোধের তলদেশ যদি দুলে না ওঠে চেনা-অচেনা কোনো বোধের তরঙ্গে, তা হলে ওই কবিতা কি ব্যর্থ নয়? এই যে কিছু সঞ্চার করা এবং বোধের তরঙ্গে তলদেশ দুলে ওঠা—এটা সবচেয়ে বেশি হয় নীতি-কবিতায়। হয় কেন? এজাতীয় কবিতায় প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়ের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ হয় বলে, ভাষা ও বর্ণনা ঝরঝরে নির্ভার হয় বলে এবং ছন্দের সুরেলা ঝঙ্কার পাঠকের হৃদয়কে নাচিয়ে তুলে বলে। কবিতার একদল সমালোচক সেই আদিকাল থেকেই বলে আসছেন, কবিতাকে আনন্দ দিতে হবে, আবার উপদেশও দিতে হবে। কবিতা থেকে কোনো একরকম নৈতিক সহায়তা পাওয়া আকাঙ্ক্ষাটা একসময় মানুষের মজ্জাগত ছিল। কিন্তু পরে অন্যায়ভাবে তাকে আপন নিবাস থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ‘কবিতার কাজ হচ্ছে খুলে দেখানো, শেখানো নয়’। কিন্তু কেন? তার কাজ তো একই সঙ্গে খুলে দেখানো এবং শেখানোও। ব্যক্তি মানুষের হৃদয়ানুভূতি যেমন নিজে উপভোগ করার মতো, তেমনি তা অপরের ভেতর সঞ্চার ও শেয়ার করার মতোও। শুধু সৃষ্টি করলে কী হবে? সরবরাহও তো করতে হবে। কবিমাত্র মানবের মাঝে শাশ্বত জীবনবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। তাঁর বোধ ও ভাবনার রাজ্যে দিবারাত যে সংক্রমণ, তা তিনি চালিয়ে দিতে চান সবার মাঝে। তাই তার ব্যক্তিক অনুভূতি হয়ে ওঠে সবার অনুভূতি। কবিতা কোনোমতেই ধর্ম নয়; আবার ধর্মকথাদীপ্ত কবিতাও অকবিতা নয়। কবিতা যা দিতে পারে, তার কাছে তার চেয়ে বেশি চাওয়াটা ঠিক নয়, আবার যা দিতে পারে, তা ফিরিয়ে দেয়াও যৌক্তিক নয়। কবিতা শুধু মলমের কাজ না, মহৌষধের কাজও করে। কবিতাকে প্রচার করতে হয় না ধর্মতত্ত্ব ও নীতিকথা। কিন্তু এগুলো প্রচার করলেও মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। কবিতা মানুষকে সচেতন করে, সজীব করে—এমনকি তাদের আমূল পরিবর্তনও করতে পারে। যেমন পারে ধর্ম ও নীতি। 


            গবেষকরা বলেছেন, বাংলাসাহিত্যে নীতি-কবিতার জন্ম হয় মধ্যযুগে। ওই সময় ভারতজুড়ে নানা পরিবর্তন, আন্দোলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ। মানুষের মূল্যবোধ তখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। চারিত্রিক শুদ্ধচারিতা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। ঠিক ওই সময় নানা নৈতিক উপদেশ ও নীতিকথা কাব্যের আদলে অভিব্যক্ত হয়। তবে তখন নীতি-কবিতার আঙ্গিকরীতি নিয়ে তেমন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি, তাতে তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই মূলত আধুনিক আঙ্গিকে বাংলাসাহিত্যে নীতি-কবিতার ব্যাপক-বিচিত্র প্রকাশ ও প্রসার ঘটেছে। বাংলা নীতি-কবিতা যাদের চর্চায়-পরিচর্যায় ও সচেতন প্রয়াসে সমৃদ্ধ হয়েছে, তাদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৭-১৯০৭), রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), শেখ ফজলুল করীম (১৮৮২-১৯৩৬), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩), ডা. লুতফর রহমান (১৮৮৯-১৯৩৬), শেখ হবিবর রহমান (১৮৯১-১৯৬২), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯), কাজী কাদের নেওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কবিদের মধ্যে কেউ কেউ নীতি-কবিতা-রচনার প্রতি এত বেশি ঝুঁকেছিলেন যে, তাদের একাধিক স্বতন্ত্র গ্রন্থ আছে নীতি-কবিতা নিয়ে। যেমন—রজনীকান্ত সেন। তার দু’টি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ রয়েছে শুধু নীতি-কবিতা নিয়ে। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অমৃত’ আটচল্লিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে এবং ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘সদ্ভাব কুসুম’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাকাব্যের এই ঐতিহ্যধন্য ধারাটি ক্রমনিম্নগামী হয়ে এক সময় হারিয়ে গেছে। খোদাবন্দনা ও রাসুলপ্রশস্তির ধারাটি, যদিও নিভু নিভু অবস্থায় কোনোরকম টিকে আছে। কিন্তু নীতি-কবিতার ধারাটি একেবারে হারিয়ে গেছে বললেও চলে। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের পর থেকে নীতি-কবিতা-রচনার প্রয়াস তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। এখন নীতি-কবিতার নিরাপদ আশ্রয় বলতে শুধু কয়েকখানা পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা। সেখানেও আবার কর্তন-বিয়োগের আজব খেলা। সেই শৈশবে যে পড়েছিলাম ‘এই করিনু পণ মোরা/এই করিনু পণ ফুলের মত গড়ব মোরা মোদের এই জীবন’ কিংবা ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’—এগুলো এখন আর দেখা যায় না। অথচ একথা সবাই মানবেন যে, সার্বিক নীতিভ্রষ্ট ও নীতিশূন্যতার এ কালিমাচ্ছন্ন সময়ে নীতি-কবিতারই প্রবল প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যাতে ব্যক্তিতে, সমাজে, বিশেষ করে আমাদের সমাজের তরুণ ও কিশোরদের মাঝে নৈতিকতার নতুন জাগরণ সূচিত হয়। আশার কথা হলো, বিদ্বত্সমাজ এই কবিতাসত্তাকে একেবারে ভুলে যাননি। অন্তত ক্ষুদ্রকায় কিছু সঙ্কলন বের করে হলেও তাকে স্মরণ রেখেছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে ধন্যবাদ দিতে হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি ‘বাংলাসাহিত্যের সেরা উপদেশমূলক কবিতা’ নামে একটি সঙ্কলন বের করে ১৯৯০ সালে। সেটির দ্বিতীয় সংস্করণও বের হয় ২০০০ সালে। কিন্তু বাংলাসাহিত্যের নীতি-কবিতার সমাদরপূর্ণ সংখ্যাধিক্যের তুলনায় সঙ্কলনটি খুবই ক্ষুদ্র ও ক্ষীণকায়। মাত্র পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার বইটিতে আটত্রিশজন কবির মোট একশ’ চারটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সেই সঙ্গে ‘বাঙালি-স্বভাব’ সুলভ অযত্ন ও অনুসন্ধিত্সার অভাবও সৃস্পষ্ট। নীতি-কবিতা বা উপদেশমূলক কবিতার সঙ্কলন থেকে গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭১৯৬৪), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯) ও কাজী কাদের নেওয়াজ (১৯০৯-১৯৮৩) কেন বাদ পড়েছেন, সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার। অথচ এখনও গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’, আবদুল কাদিরের ‘মানুষের সেবা’ ও মৈত্রী’, বন্দে আলী মিয়ার ‘আমাদের গ্রাম’, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ ও ‘মা’ পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও এঁদের আরও একাধিক নীতি-কবিতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাঁদের কাব্যসম্ভরে। নীতি-কবিতার নানাকৌণিক রূপ-গুণ ও অবদানের ফলে কিছু কিছু কবিতা প্রবাদ-প্রবচন ও কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। সেগুলো এখনও মানুষের জিহ্বায় নেচে ওঠে, দুলিয়ে দেয় হৃদয়ের রুমাল। যেমন ধরা যাক— আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়/লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। চিরসুখী জন/ভ্রমে কি কখন/ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কী যাতনা বিষে/বুঝিবে সে কিসে/কভু আশী বিষে দংশেনি যারে। যে জন দিবসে/মনের হরষে/জ্বালায় মোমের বাতি/আশু গৃহে তার/দেখিবে না আর/নিশিতে প্রদীপ ভাতি। (কৃষ্ণকুমার মজুমদার) পারিব না এ কথাটি বলিও না আর/কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার। (কালীপ্রসন্ন ঘোষ) আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে/ সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। (কামিনী রায়) বাবুই হাসিয়া কহে, ‘সন্দেহ কি তায়?/কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়,/পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা/নিজের হাতে গড়া মোর কাঁচাঘর খাসা। (রজনীকান্ত সেন) আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে/মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন/মানুষ হইতে হবে এই তার পণ/বিপদ আসিলে কাছে হয় আগুয়ান/নাহি কি শরীরে তার রক্ত মাংস প্রাণ? (কুসুমকুমারী দাশ) ‘দাঁত আছে বলে কুকুরের গায়ে দংশি কেমন করে/কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়ে পায়,/তা’ বলে কুকুরে কামড়ানো কি রে মানুষের শোভা পায়?’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত, মূল শেখ সাদী) গোলাপে ছিঁড়িয়া কেহ কি পেরেছে হাসি তার কেড়ে নিতে?/ধুলায় পড়েও হাসি ফোটে তার পাপড়িতে পাপড়িতে! (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত, মূল, জালালুদ্দীন রুমী)।  Source: Daily Amardesh


Saturday, March 23, 2019

সায়ীদ আবুবকর: বাংলাদেশের এই কবি সারা পৃথিবীর ১০০ সেরা কবির অন্যতম এবং তিনি চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া থেকে সংবর্ধিত

     বিশ্ববিখ্যাত পোয়েম হান্টার এর জরিপমতে বর্তমানে কবি সায়ীদ আবুবকর বিশ্বের টপ ৫০০ কবির মধ্যে ১০০-এর ভেতরে অবস্থান করছেন। স্পানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। মেক্সিকো হতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে  স্পানিশ ভাষায় অনূদিত তাঁর কবিতাবলি দিয়ে সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ। সম্প্রতি ফিলিপাইনের চেবু ইউনিভার্সিটিতে লিটারেরি ক্রিটিসিজম-এ পঠিত হচ্ছে তাঁর দু'টি কবিতা ‘এ স্ট্রেন্জ বয়' এবং ‘মাই মুন'। সায়ীদ আবুবকরের ৭টি কাব্যগ্রন্থ যেমন তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে বাংলাদেশে, তেমনি তাঁর অনূদিত ১১৯ টি ইংরেজি কবিতা তাঁকে দিনদিন জনপ্রিয় করে তুলছে বহির্বিশ্বে।

     কবি সায়ীদ আবুবকরকে সংবর্ধিত করা হয় চিনের ইনার মঙ্গোলিয়া থেকে।গত ২১ মার্চ ২০১৯ তারিখে ইনার মঙ্গোলিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্য সেকেন্ড ক্যাটস আই পোস্ট মোডার্নিস্ট এন্ড হাইকু পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যালে ‘ফেস্টিভ্যাল পোয়েট’ হিসেবে বাংলাদেশের কবি সায়ীদ আবুবকরের নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্ব-কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য কবি সায়ীদ আবুবকরকে পুরস্কৃত ও সার্টিফিকেট প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে প্রকাশিত জার্নালে কবি সায়ীদ আবুবকরের ‘এ কন্ট্রাস্ট’ কবিতাটি চিনা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে।

     সায়ীদ আবুবকর মূলত কবি। আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গনে তাঁর প্রকৃত উত্থান ঘটে নববইয়ের দশকে। ১৯৯৬-এ প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রণয়ের প্রথম পাপ তাঁকে মৌলিক শক্তিশালী কবিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। সমালোচকদের বিচারে তিনি নববইয়ের দশকের প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর কবিতার উপর প্রবন্ধ লিখেছেন পঞ্চাশের প্রধান কবি আল মাহমুদসহ তরুণ প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিকরা। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৭:
১. প্রণয়ের প্রথম পাপ (১৯৯৬, পালাবদল পাবলিকেশন, ঢাকা ; ২য় সংস্করণ ২০০৮, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)
২. জুলেখার শেষ জাল (২০০৪, পালাবদল পাবলিকেশন, ঢাকা ; ২য় সংস্করণ ২০১১, পরিলেখ, রাজশাহী)
৩. সাদা অন্ধকারে কালো জ্যোৎস্নায় (২০০৬, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)
৪. মেসোপটেমিয়ার মেম (২০০৭,  ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)
৫. বঙ্গেতে বসতি (২০০৮,  ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)
৬. এবার একটিবার একসাথে (২০১১ ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)
৭. কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর (২০১২, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা ) 
প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই তাঁর কাব্যসত্তা মৌলিকত্বে ও নতুনত্বে স্বকীয় আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি অত্যন্ত সচেতন কবি। ছন্দ-অলংকারে তাঁর নৈপুণ্য ঈর্ষণীয়। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-অনুপ্রাস তাঁর কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে দিয়েছে গীতলতা ও সুরের ঝংকার। কাব্যে তিনি কখনও বিদ্রোহী, কখনও রোমান্টিক, কখনও দরবেশী ভাবলুতায় নিমগ্ন এক তপসী। দেশ, মাটি ও মানুষ সবকিছু নিয়ে তিনি এক ভিন্ন কণ্ঠস্বর আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গনে। তরুণ কবিদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি বাংলাদেশে। 

     সায়ীদ আবুবকর একজন সফল অনুবাদকও। বাংলাভাষায় তিনি মধুসূদনের ইংরেজি কবিতার প্রথম অনুবাদক। তাঁর অনূদিত মধুসূদনের ইংরেজি কবিতা (২০০৯, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, ঢাকা)  একটি অসম্ভব সফল অনুবাদগ্রন্থ যা দুই বাংলায় ব্যাপক পঠিত, যা তাঁকে এনে দিয়েছে বাংলা ভাষায় ক্লাসিক অনুবাদকের খ্যাতি। এছাড়া তিনি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন আল মাহমুদের সোনালি কাবিন দ্য গোল্ডেন কাবিন (২০১০, যুক্তরাষ্ট্র) শিরোনামে, যা প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ায়।

     দেশ ও বিদেশ থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন কবি সায়ীদ আবুবকর। তার মধ্যে লালন পদক (২০০৯), সৈয়দ আলী আহসান সিএনসি পদক (২০১৭), রক পেবলস ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড ২০১৭ (ভারত), ভাষা স্মারক পদক (২০১৮, কোলকাতা) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ফেইসবুকে কবি আবিদ আনোয়ারের কিছু পোস্ট - কিছু মতামত


কবি আবিদ আনোয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লিংকে ক্লিক করুন: কবি আবিদ আনোয়ার এবং তার সম্পর্কে অত্র ব্লগ-সাইটের সমস্ত পোস্ট সম্পর্কে জানতে এই লেবেল লিংকে ব্রাউজ করুন:  কবি আবিদ আনোয়ার

ফানি কবিতা আবৃত্তি- যে জন দিবসে মনের হরশে জ্বালায় মোমের বাতি


Friday, March 22, 2019

জসীম উদ্দীন — আধুনিক কবি



- তি তা স চৌ ধু রী

    কবি জসীম উদ্দীনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কবিতার একটি ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। জসীম উদ্দীনই ছিলেন সেই ধারার শেষ প্রতিনিধি। ১৪ মার্চ, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে জসীম উদ্দীন এই রৌদ্রছায়াময় পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেন। জসীম উদ্দীন সেদিন শেষ রাতেই পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। সে জন্য তাঁর মহাপ্রয়াণ সংবাদ আমি আমার এক ছাত্র মারফত সকালে জানতে পারি। পরে রেডিওতে শুনি। কবির মৃত্যু সংবাদে সেদিন অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তিনি কুমিল্লায় এসেছিলেন অলক্তের আমন্ত্রণে। তিনি প্রায় ষাট ঘণ্টার মতো কুমিল্লায় ছিলেন। এই সময়ে আমার বাসাটি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল।
    সারা দিনরাত শুধু মানুষ আর মানুষ। কবিকে এক নজর দেখতে এসেছিলেন। কাউকে তো ‘না’ করা যায় না—পেছনে কবি আবার অসন্তুষ্ট হন। জসীম উদ্দীন যে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, আমি সেদিনই তা টের পাই। শুধু শিক্ষিত নন, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত—এমন বহু মানুষ কবিকে দেখতে এসেছিলেন। বোধ করি এই শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মানুষই কবিকে একদিন ‘পল্লীকবি’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন এবং কবিও তা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। জীবনের শেষদিকে কবি তাঁর নামের শেষে ‘পল্লীকবি’ শিরোপাটি জুড়ে দিতেন। কারণ ওই সময়, কবি কথায় কিছু লেখকের উদয় হয়েছিল, যাঁরা জসীম উদ্দীন নামে পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলেন। কবির জসীম উদ্দীন তাই দেখেই গ্রামবাংলার জনগণের দেয়া খেতাব তিনি নামের শেষে জুড়ে দিয়েছিলেন। তাতে জসীম উদ্দীন থেকে অন্যরা অনায়াসেই পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘পল্লীকবি’ জসীম উদ্দীন মানে এই নয় যে, তিনি পল্লীকবি ছিলেন।
    জসীম উদ্দীন ছিলেন বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। কেননা তিনিই একদিন দুঃসাহসিক অঙ্গীকার নিয়ে বলতে পেরেছিলেন—‘তোমার গেঁয়ো মাঠটি আমার মক্কা হেন স্থান।’ পল্লীদরদী না হলে এমত উচ্চারণ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যে কথা বলছিলাম, জসীম উদ্দীন কি পল্লীকবি? বাস্তবে এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। আমরা লক্ষ্য করেছি, এক শ্রেণীর গেঁয়ো কবি পল্লীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, প্রেম-বিরহ-যাতনা, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার চিত্র তুলে ধরেন অত্যন্ত অমার্জিত ভাষায় ও ছন্দে। কোনো কাহিনীর উদ্ভট রূপায়ণে কিংবা কোনো বিরহ উপাখ্যান নির্মাণে গেঁয়ো কবিরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অতি সহজেই। এতে একদিকে যেমন থাকে শিল্প চেতনার অভাব—তেমনি অন্যদিকে রুচি, মননশীলতা ও রসোপযোগিতার দৈন্য। এ সত্ত্বেও, লোক জীবনে এগুলোর আদর ও কদর অল্প নয়। এগুলো অমার্জিত ও অশ্লীল হলেও এসব ‘কথাকাব্য’ সর্বত্র সমাদর লাভ করে। যেমন মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য, কালিকা মঙ্গল কাব্য, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, মৈমনসিংহ গীতিকা ইত্যাদি একই জাতের কাব্য পদবাচ্য। অবশ্য পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও মৈমনসিংহ গীতিকা ‘কথাকাব্য’ হিসেবে প্রচুর সমাদর লাভ করেছে, সন্দেহ নেই।
    মোটকথা, এ ধরনের গীতিকা কিংবা কাব্যের রচয়িতাকে সাধারণত পল্লীকবি বা গেঁয়ো কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাহলে জসীম উদ্দীন কি এই অর্থে পল্লীকবি? জসীম উদ্দীন এ সংকীর্ণ অর্থে পল্লীকবি নন। কেননা জসীম উদ্দীনের নক্শী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা কিংবা বেদের মেয়ে ইত্যাদির উপাদান-উপকরণ পল্লীতে পাওয়া গেলেও কোনো গৃহস্থ ঘরে এসব প্রাপ্তি রীতিমত দুঃসাধ্য। এছাড়া শিল্পসম্মত কাহিনী বুনন, কবিতার শব্দচয়ন, উপমা-উেপ্রক্ষা, চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক নির্মাণে এ সত্য প্রমাণ করে না। রাখালী, কবর কিংবা পল্লীজননী যে কোনো একটি কবিতা নিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে—জসীম উদ্দীনের কবিতায় কিংবা কব্যোপন্যাসে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার বড় একটা দেখা যায় না। যে দু’চারটি প্রয়োগ দৃষ্টিগোচর হয় তাও মার্জিত এবং কুশলী হস্তে ব্যবহৃত। সুতরাং জসীম উদ্দীনে একজন পল্লীকবির চরিত্র ও চারিত্র্য মোটেও ধরা পড়ে না। যদিও বলা হয়ে থাকে, তাঁর মতো এমন ষোলআনা পল্লী দরদী কবি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এর অর্থ এই নয় যে তিনি পল্লীকবি। বড়জোর ‘লোককবি’ বলা যায়। কারণ গ্রামজীবন ও পরিবেশ তাঁর কাব্যে উপাদান জুগিয়েছে এবং তাঁর কবিতা-কলাকুশলের মধ্যেও গ্রাম্য আবহকে আমরা মূর্ত হতে দেখি। কিন্তু তাই বলে তিনি গ্রাম্য কবি নন। তাঁর চারণ-উপমা-রূপক প্রয়োগে তিনি যথেষ্ট মুন্শীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
    জসীম উদ্দীন আসলে আধুনিক কবি। কারণ তিনি যেসব উপমা ব্যবহার করেছেন সেগুলোর উপাদান গ্রাম থেকে সংগৃহীত হলেও এর ব্যাখ্যাসূত্র প্রধানত নাগরিক। আবু সয়ীদ আইয়ুব আধুনিক শব্দটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক হিসাবে যারাই আধুনিককালে কবিরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রতিভা ও সাধনার, যুগ্ম অধিকারে, তাঁরাই আধুনিক কবি যুগলক্ষণ অধিকৃত না হলেও। সুতরাং এ অর্থেও জসীম উদ্দীন আধুনিক কবি। অন্য পক্ষে ‘আধুনিক’ বাংলা কবিতার ভাব প্রকাশ ও আঙ্গিকে যাঁরা পরিবর্তন এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি তিনি। শুধু গ্রামীণ কবি ছিলেন না। কাহিনী কাব্য, ছন্দ ও গীতিময়তায় তিনি বাংলা কাব্যের নয়াদিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁকে বাদ দিয়ে আধুনিক কবিতার কথা চিন্তা করা যায় না।
    তবে প্রশ্ন ওঠে, তিরিশ কিংবা তিরিশোত্তর কবিরা যে অর্থে আধুনিক, ছিলেন, জসীম উদ্দীন কি সে অর্থে আধুনিক? এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। কেননা বুদ্ধদেব বসু ও আহসান হাবীব যে অর্থে আধুনিক, বিষ্ণু দে ও শামসুর রাহমান সে অর্থে আধুনিক নন। আবার জীবনানন্দ দাশ ও অমিয় চক্রবর্তী যে অর্থে আধুনিক, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা প্রেমেন্দ্র মিত্র কিংবা সমর সেন সে অর্থে আধুনিক নন। বস্তুত আধুনিক শব্দটি জবষধঃরাব বা আপেক্ষিক। আধুনিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উক্তি—‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ আবার জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, ‘বাংলা কাব্যে কিংবা কোনো দেশের বিশিষ্ট কাব্যে আধুনিকতা শুধু আজকের কবিতায় আছে—অন্যত্র নয়, একথা ঠিক নয়।’ আবার কেউ বলেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত অন্তত মুক্তিপিয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি।’ সুতরাং এসব অভিধায়ও জসীম উদ্দীন আধুনিক কবি।
    তাঁর প্রকৃত পরিচয়—তিনি পল্লীবোধ ও পল্লী ইমেজের কবি। এর কারণও এই যে, প্রকৃতি উত্সারিত স্বাভাবিক ও মৌলিক লোকজ ধারাটি তাঁর আগে আর কেউ তেমন সহজভাবে আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে এক করতে সক্ষম হননি। এটি জসীম উদ্দীনের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল এজন্য যে, তিনি ছিলেন গ্রাম ও গ্রামবাংলার এক স্বাভাবিক অংশ। আর সেজন্যই তাঁর কবিতায় পল্লী প্রকৃতি, লোক জীবন ও লোক ঐতিহ্য অপূর্ব রূপলাভ করেছে।
    জসীম উদ্দীনের কাব্যে পল্লী প্রকৃতি যেভাবে উপমা-উেপ্রক্ষা, রূপক ও চিত্রকল্প তথা আধুনিক কবিতার লক্ষণযোগে ধরা দিয়েছে—সমগ্র বাংলা কাব্যে এর দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। দু’তিনটি নজির এখানে খাড়া করি।
যেমন :
এই গাঁয়ের এক রাখাল ছেলে লম্বা মাথার চুল
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!
কাঁচাধানের পাতার মতো কচি মুখের মায়া
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দু’খান সরু
গা-খানি তার শাওন মাসের যেমন তমালতরু।
[নকশী কাঁথার মাঠ]
কিংবা
দূর্বাচলে রাখলে তারে দূর্বাতে যায় মিশে,
মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।
বনের মাঝে বনের লতা পাতায় পাতায় ফুল
সেও জানেনা-নমু মেয়ের শ্যামল শোভার তুল।
[সোজন বাদিয়ার ঘাট]
এবং এভাবেই রূপকে-প্রতীকে-চিত্রকল্পে এবং উপমা-উেপ্রক্ষায় সমস্ত পল্লী প্রকৃতির ভেতরে ছড়ানো আছে জসীম উদ্দীনের কবিতার সাম্রাজ্য। মূলত সব দিক বিবেচনায় সহজেই বলা যায়, তিনি আধুনিক যুগের কবি।

কবি আবুল হোসেন: নববসন্ত থেকে কালের খাতায়


হা সা ন শা ন্ত নু

   বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি আবুল হোসেন। বাঙালি মুসলমানের আধুনিক সাহিত্যের ‘সপ্তরথী’র প্রথম পুরুষ তিনি। আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস, ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ—এ সাতজনকে ‘সপ্তরথী’ বলা হয়। বাঙালি মুসলমানদের জন্য আলাদা সংস্কৃতি, শিল্প আবুল হোসেনের একান্ত কাম্য ছিল। তবে চূড়ান্ত ও মৌলিক অর্থে তিনি সমাজ শিল্পের সামগ্রিক উত্তরণ কামনা করেছেন, বাঙালি মুসলমান সমাজের অবরুদ্ধ জীবন-চেতনার উত্তরণ কামনায় নিয়োজিত থেকেছেন। তাঁর সমকালের কবিদের মধ্যে কেউ কেউ নতুনকে বরণ করে নেয়ার বদলে অতীত আঁকড়ে থাকার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আর তিনি বলেছেন জাগরণ, সমুন্নয়নের কথা। তাঁর দৃঢ়তম উচ্চারণ—‘হে কূর্ম তোমার অন্ধকার, বর্মের গোপন গুহা থেকে, বের হয়ে এসো আজ নির্ভয়ে, এখনও ছিন্ন করো শতাব্দীর কুয়াশায় ঘন, ভ্রান্তির তিমির…।’ নতুন চেতনা, সময় দরকার বাঙালি মুসলমানের শিল্প ও জীবনে—এসব দিক চল্লিশের দশকে মাত্র কয়েক কবি অনুধাবন করেন। সে জন্যই মুসলমান কবিদের আধুনিক কবিতা বিষয় ও রীতি নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষার অব্যাহত একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। ওই কবিদের মধ্যে আবুল হোসেন নিঃসন্দেহে অন্যতম। ‘নবযুগ’ কবিতায় তিনি বলেছেন, মুসলমানদের দিনবদল হচ্ছে। এ কবিতা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ত্রিশের দশকের মাঝামাঝিতে প্রথম প্রকাশিত হয়।
    আবুল হোসেন ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। ওই সাহিত্য সমিতির মাসিক সভায় একাধিকবার তিনি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় আয়োজিত এক সাহিত্য সভায় তিনি ‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সাধনা’ শিরোনামের এক প্রবন্ধ পড়েন। তাঁর এ প্রবন্ধ মুসলমান কবি-লেখকদের তখন নতুনভাবে ভাবিয়ে তোলে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির একটি সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয় কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে। প্রখাত সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ওই মননশীল সভার সভাপতি। সভায় আবুল হোসেন ‘আমাদের মননশীল সাহিত্য’ শিরোনামে প্রবন্ধ পড়েন। ওই প্রবন্ধও বাঙালি মুসলমান কবি-লেখকদের আলোড়িত, ভাবিত করে। প্রবন্ধটি কাজী মোতাহার হোসেন এত পছন্দ করেন যে, পড়া শেষ করতেই তিনি আবুল হোসেনকে জড়িয়ে ধরেন।
আবুল হোসেনকে বলা হয় ‘প্রথম আধুনিক-চেতনা, অবচেতনা, সফিসটিকেশনের কবি’। বাংলা কবিতার ধারা যদি এরকম হয়—বৈষ্ণব কবিতার যুগ, রবীন্দ্র-নজরুলের যুগ, মাইকেল মধুসূদনের যুগ ও আধুনিক বাংলা কবিতা; তাহলে বলতে হবে আধুনিক বাংলা কবিতার ধারাটা শুরু হয়েছে আবুল হোসেনের সময় থেকে। চল্লিশের দশকে তিনি বাংলা কবিতায় যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেন; চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, একুশ শতাব্দীর শূন্য দশক ধরে সেই আধুনিকতারই নানামুখী চর্চা চলেছে এ দেশের কবিদের হাতে। কবি বিষ্ণু দে’র ‘এক সূত্রে’ কবিতা সঙ্কলনে মুসলমান আধুনিক কবিদের মধ্যে কেবল আবুল হোসেন আর গোলাম কুদ্দুসের কবিতাই ঠাঁই পেয়েছে।
  সে জন্য তাঁকে কেবল ‘বাঙালি মুসলমানদের প্রথম আধুনিক কবি’ বলাটা এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা চর্চার মতো। কেননা, তিনি দুই বাংলার চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে আধুনিক কবি, অন্যতম প্রধান কবি। ত্রিশের দশকের কবিদের অকারণ ‘রবীন্দ্র বিরোধিতা’, ইউরোপের সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণ আধুনিক কবিতা হিসেবে কালের বিচারে চিহ্নিত হয় না। তাদের কবিতায় সূক্ষ্মতার চেয়ে স্থূলতা অনেক বেশি। এসব বিবেচনায় চল্লিশের দশকেই আধুনিক কবিতার সূত্রপাত। জীবনের ধাপে ধাপে কবিতার বিষয় থেকে বিষয়ে গেছেন আবুল হোসেন অননুকরণীয়ভাবে। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন সব সময়। তাঁর কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য, আর্শ্চয রকমের সরলতা। বলার ভঙ্গিটা এত চেনা যে, মনে হয় কবি পাঠকের সঙ্গে কথার বুনন নির্মাণ করে চলেছেন। অথচ ছন্দমিলের বৈচিত্র্যে প্রতিটি কবিতাই ঋদ্ধ। সরল বর্ণনাতেও ছড়িয়ে থাকে বুদ্ধির দীপ্তি, ব্যঙ্গের সূক্ষ্ম আঁচড়, প্রতীক ও চিত্রকল্পের স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়োগ। তিনিই বাংলা কবিতার একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা কবিতার তিন প্রধানতম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের সংস্পর্শে এসেছেন। তবে এখনও তিনি প্রতি মুহূর্তে তরুণ। প্রতি মুহূর্তে নবায়ন করেন নিজেকে তরুণতম, সবচেয়ে আধুনিক রাখতে।
    এটাও সত্য, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য এক সত্য। এ উপমহাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোনো দেশের প্রধান ভাষায় লেখা সাহিত্যে এরকম সাম্প্রদায়িকতা আছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বকবি’, তিনি তাঁর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে তাকিয়েছেন খুব সামান্যই। মুসলমানদের নিয়ে তাঁর লেখার তালিকা টানতে গেলে রবীন্দ্রপ্রেমীদের ‘অসাম্প্রদায়িকতার গর্ববোধ’ ম্লান হয়ে যায়। আবার রবীন্দ্র সমসাময়িকের মুসলমান কবি-লেখক ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হকরাও নিজ ধর্মের বাইরে তাকাননি। সম্প্রদায়গত চিন্তা-চেতনা থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে কবি-লেখকদের মূল্যায়ন না করার মানসিকতা তখন ছিল ভয়াবহ রকমে প্রবল। হিন্দু ধর্মের অনুসারী কবি-লেখকদের এরকম মানসিকতা ছিল ভয়ানক রকমে। মুসলমানদের মধ্য থেকে যারা অসাধারণ লিখতেন, তাদের মুসলমান কবি-লেখক বলে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, কৌশলটার চর্চা আজও চলছে। তাতে এখন সেক্যুলার কয়েক মুসলমান কবিও যুক্ত আছেন। যারা আবুল হোসেনকে ‘গণ্ডির’ মধ্যে আটকে রাখতে চান, তাদের মধ্যে অনেকে কবিতা ও সাহিত্যের বিচারে আবুল হোসেনের পেছনের সারিতে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও রাখেন না।
    আবুল হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট, বাগেরহাট জেলায়। ছেলেবেলা কেটেছে কুষ্টিয়ায়। প্রথম যৌবন কলকাতায়। সাতচল্লিশে দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান জন্মের দিন ১৪ আগস্ট চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নববসন্ত’ বের হয় ১৯৪০ সালে, কলকাতার বুলবুল পাবলিশিং হাউস থেকে। দ্বিতীয় বই ‘বিরস সংলাপ’ ঢাকা থেকে বের হয় ১৯৬৯ সালে। এরপর একে একে বের হয়—হাওয়া তোমার কি দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে, এখনো সময় আছে, রাজরাজড়া, কালের খাতায়, আমার এই ছোট ভুবন, আর এক ভুবন, দুঃস্বপ্নের কাল, স্বপ্নভঙ্গের পালা ইত্যাদি।
    ‘নববসন্ত’ বইটি কবি উত্সর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে বইটির কোনো কপি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আবুল হোসেনের মনে দুঃখবোধ জমে আছে। তাঁর মতে, ‘ওটা যতোদিন বেঁচে থাকি, ততোদিনই থাকবে।’ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘হে ধরণীর কবি’ নামে একটি কবিতা পাঠান। ওই কবিতা অক্ষরবৃত্তে ২৬ মাত্রায় লেখা ছিল। কবিতাটি পেয়ে লম্বা খামে ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠান রবীন্দ্রনাথ। তাতে লেখা ছিল ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
    রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের সাহিত্যগত বিতর্কও হয়েছে। ১৯৩৭ সালে আবুল হোসেনের প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ নিয়ে এ বিতর্ক হয়। ওই বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘গদ্য কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধই পরের বছর শোধিত-বর্ধিত হয়ে ‘গদ্য কবিতা ও তার ছন্দ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তিনি প্রবন্ধটিতে গদ্য কবিতার বিরুদ্ধে বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল এরকম—‘ছন্দ একেবারেই অপরিহার্য।’ রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনের এক অভিভাষণে আবুল হোসেনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন। অবশ্য প্রবন্ধটি লেখার অল্পকাল পরে আবুল হোসেন নিজেও গদ্য কবিতা লেখা শুরু করেন, যা এখনও অব্যাহত আছে।
    রবীন্দ্রনাথও ফিরে গেছেন গদ্য কবিতা থেকে ছন্দোবদ্ধ কবিতায়। দুই কবির এ বিতর্ক চিহ্নিত করতে বাংলা সাহিত্যের আরেক কবি-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘এসব হচ্ছে শিল্পীর শিল্প বিবেচনা থেকে শিল্প সৃজনের মজাদার বৈপরীত্য।’ বিতর্কের পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আবুল হোসেনের দেখা ও কথাবার্তা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ‘রবীন্দ্র পরিষদ’-এর সম্পাদক হন তিনি ১৯৪৩ সালে।
    নববসন্ত প্রকাশিত হওয়ার পর সেই সময়ের অগ্রজ কবি, সাহিত্য সমালোচক, বোদ্ধা মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। বইটির আলোচনা বেরোয় শওকত ওসমানের ‘চতুরঙ্গ’, গোলাম কুদ্দুসের ‘সওগাত’, আবুল মনসুর আহমদের ‘কৃষক’, সুবোধ সেন গুপ্তের ‘রূপায়ণ’, নীহার রঞ্জন রায়ের ‘কবিতা’সহ ওই সময়ের আরও অনেক পত্রিকায়। আবুল হোসেনের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার। তিনিও ‘নববসন্ত’র কবিতা নিয়ে কামাক্ষীপ্রাসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতেন, যা তাঁর ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ নামে জীবনী বইয়ে লিখে গেছেন।
    বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষে এসে পৌঁছেছেন আবুল হোসেন। বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে এমন নির্লোভ-নির্দলীয় কবি আর দ্বিতীয়জন নেই বলা যায়। দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা করছেন। এ সময়ের মধ্যে দেখেছেন অসহযোগ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদ, কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, বিয়াল্লিশের দুর্ভিক্ষ, কলকাতায় জাপানি বোমার আক্রমণ, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে টানাপড়েন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারতবর্ষ ভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এরপর অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নৈরাশ্য, সেনা বিদ্রোহ, সামরিক শাসন কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা। জীবন পরিক্রমায় দেখা প্রায় সব কিছুই উঠে এসেছে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীতে। পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে লিখেছেন ‘সন্দিহান’ কবিতা। গোপাল ভৌমিকের সম্পাদনায় ‘পঞ্চাশে’ নামে ওই মন্বন্তর নিয়ে কবিতা সঙ্কলন বের হয়। তাতে ছিল আবুল হোসেনের ‘মেহেদির জন্য’ কবিতাটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিরোধী কবিতা লেখার ধুম পড়ে। সমসাময়িক কবি আহসান হাবীব ‘হে অসি বাঁশরি হও’, সৈয়দ আলী আহসান লিখলেন—‘হে বাঁশি অসি হও’। আবুল হোসেন অসি, বাঁশি নিয়ে লেখেননি। তিনি লিখলেন ‘সৈনিক’ কবিতাটি। এ কবিতার ভাষা, ভাবনা তাঁকে চিহ্নিত করে তোলে সত্যিকার আধুনিক কবি হিসেবে। সেটি ১৯৩৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ছাপা হয়। পরে একাধিক পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে পুনর্মুদ্রিত হয়। কবি নিজে পরে কবিতাটির নাম বদলে করেছিলেন ‘ঘোড়সওয়ার’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘ঘোড়সওয়ার’ যুদ্ধবিরোধী কবিতা। তাঁর বিখ্যাত কবিতার মধ্যে আরও আছে ‘বাংলার মেয়ে’, ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’, ‘ডাইনামো ট্রেন’ ইত্যাদি। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’য় ‘ডি.এইচ. রেলওয়ে’ প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পাহাড়ি ট্রেন পথের বর্ণনা। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের এক যাত্রা কবি এ কবিতায় সানন্দে ছন্দ, শব্দ, ধ্বনিতে বর্ণনা দেন। এরকম কবিতা বাংলা সাহিত্যে গবেষক-সমালোচকরা দ্বিতীয়টি এখনও খুঁজে পাননি।
    অল্প বয়সেই লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন আবুল হোসেন। কুষ্টিয়া হাই স্কুলে এইটে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ‘আকবরের প্রতি রানা প্রতাপ’ নামে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে মাইকেল মধুসূদনের অনুসরণে লেখা ছিল সেটি। ১৯৩৭ সালে ওই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে সে বছর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির পর কলেজের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ। এরপর চতুরঙ্গ, কবিতা, পূর্বাশা, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অরণি, নিরুক্ত, নবশক্তি, মাসপয়লা, পাঠশালা, শিশু সওগাত, নবযুগ, ত্রিকাল, রবিবার পত্রিকায় কবিতা, প্রবন্ধ, সাহিত্য-শিল্প, সংস্কৃতি সম্পর্কিত আলোচনা, ভ্রমণ বৃত্তান্ত প্রচুর লিখেছেন। এখন বাংলা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা লিখছেন।
সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। ষাটের দশকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের সঙ্গে ‘সংলাপ’ পত্রিকা বের করেন। ত্রৈমাসিক এ পত্রিকার আটটি সংখ্যা বের হয় তিন বছরে। তখন ঢাকা থেকে খুব বেশি সাহিত্য পত্রিকা বেরুত না। দেশের বাইরের পত্রিকার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকদের অপেক্ষায় থাকতে হতো। তাদের তৃষ্ণা মেটানো, দলমতের বাইরে লেখকদের, বিশেষ করে নবীনদের একটা ফোরাম করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সেটি বের করেন। তাতে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরীর মতো কবি-লেখকরা লিখতেন।
    তিনি অন্যের কবিতা অনুবাদও করেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা এ দেশে তিনিই প্রথম অনুবাদ করেন। এছাড়া এইচ জি ওয়েলসের ‘ঈড়ঁহঃত্ু ড়ভ ঃযব ইষরহফ’ ‘অন্ধের দেশ’ নামে, মার্ক টোয়েনের ‘গরষষরড়হ চড়ঁহফ ঘড়ঃব’ ‘দশ লাখ পাউন্ড’ নামে, ইসমত চুঘতাইয়ের ‘ছোট মা’ গল্প (ইংরেজি থেকে), আন্তন চেখভের গল্প, পাকিস্তানের কবি ইকবালের কবিতাও অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে মাসিক মোহাম্মদী, নবযুগ ও সংলাপ পত্রিকায়। রুশ কবি রসুল গামজাতফ, আকবর উদ্দীন, দাগেস্তানের কবিতাও অনুবাদ করেছেন, যা বই আকারে বেরিয়েছে। ষাটের দশকে পাকিস্তানের ইকবাল একাডেমির আমন্ত্রণে করাচিতে একাধিকবার ইকবালের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশ নেন তিনি।
    তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন, পাশাপাশি সরকারি চাকরি, সমাজ উন্নয়নে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতি নিয়ে। এ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স নিয়ে এমএ পাস করেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন। ছোট এ দেশে জনসংখ্যা তখন বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় বাধা। একটি পরিবার বলতে তখন বোঝাত আট/দশজনের সংসারকে। জন্মনিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিল সরকার। জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করতে ও পরিবার ছোট রাখতে সরকারের স্লোগান তৈরি হলো—‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’। এ স্লোগান আবুল হোসেনের দেয়া, যা এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাংলাদেশ সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের যুগ্ম সচিব ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সালে ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দলের নেতৃত্ব দেন। এছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দেন।লেখক হিসেবে ১৯৬০ সালে বেলজিয়ামে ‘বাইঅ্যানিয়েল ইন্টারন্যাশনাল অব পোয়েট্রি’তে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সালে পাক-ভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পাকিস্তান দলের সদস্য, ১৯৭৩-এ সোভিয়েতের আলমা আতায় আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। ১৯৮৩ সালে যুগোস্লাভিয়ার স্ট্রুগা কবিতা উত্সবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬০ সালে তত্কালীন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে অতিথি-লেখক হিসেবে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর ভ্রমণ করেন।
    সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৪ সালে সিঙ্গাপুরে কলম্বো প্ল্যান কনসালটেটিভ কনফারেন্সে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে কলম্বোতে আইপিপিএফের আঞ্চলিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
   লেখক জীবনের শুরুতেই আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ূন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ মনীষীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। শিক্ষক হিসেবে আরো পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, গৌরীনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ শিক্ষাব্রতীকে। তাঁর সাহিত্য রুচি ও মানস গঠনে এদের অবদান অপরিসীম।
    আজীবন সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত থাকলেও সরকারি চাকরি ছিল প্রধান পেশা। ৩৬ বছরের কর্মজীবনে দেশে ও বিদেশে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় তথ্য, রেডিও, টেলিভিশন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন ছিলেন। যেমন জনসংযোগ ও গবেষণা এবং তথ্য সংরক্ষণ বিভাগের পরিচালক, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব পদে কাজ করে ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
    লেখক হিসেবে এবং সরকারি কাজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সোভিয়েত রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, যুগোস্লাভিয়া, ফিলিপিন্স্, শ্রীলঙ্কা, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, লাওস ও গ্রিস ভ্রমণ করেন।
    লেখার জন্য দেশ এবং সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সম্মানিত হয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কারে, জনবার্তা স্বর্ণ পদকে, নাসির উদ্দীন স্বর্ণ পদকে, একুশে পদকে। আরো পেয়েছেন পদাবলী পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, আবুল হাসনাত সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার এবং কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক ও পুরস্কার।
     তাঁকে নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন পথিক (সম্পাদক—তারেক মাহমুদ) দুটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অসাধারণ ওই দুই সংখ্যায় তার কবি, সাহিত্যের আলোচনা, মূল্যায়ন করেন দেশের খ্যাতিমান কবি, লেখক, প্রাবন্ধিকরা। পথিক-এর দুটির মধ্যে একটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের ডিসেম্বরে, অন্যটি ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
     আবুল হোসেনের ঘরোয়া জীবন হলো—১৯৫৮ সালে বিখ্যাত লেখক আকবর উদ্দীনের বড় মেয়ে সাহানা হোসেনকে বিয়ে করেন। সাহানা হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। তিনি কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থের রচয়িতা। ১৯৯৪ সালের ৮ মে আকস্মিকভাবে তিনি পরলোক গমন করেন। আবুল হোসেনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
আবুল হোসেন দীর্ঘদিন থেকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজস্ব বাসভবনে বসবাস করছেন।

আবুল হোসেন: একজন প্রকৃত আধুনিক কবির প্রোফাইল

      
- শা ম সু র রা হ মা ন 
       আবুল হোসেন চল্লিশের দশকের একজন উজ্জ্বল কবি। মুসলিম সমাজে যখন আধুনিক কবিতার মুখ লক্ষ্য করা যায় নি, তখন আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর কাব্য প্রতিভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাংলা কবিতা। আমি মনে করি, কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য সাধনা মুসলিম কবিদের আধুনিক কবিতার দিকে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম যে ক’জন তরুণ মুসলিম কবি আধুনিক কবিতা লেখার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন, তাঁরা—আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস এবং আবুল হোসেন। এদের পরে এলেন সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক এবং অন্যান্য কবি। আমি আবুল হোসেনের কবিতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন নামজাদা পত্রিকায় পড়ি। তখন থেকেই আমি তাঁর একজন অনুরক্ত পাঠক। 
       আবুল হোসেনকে আমি প্রথম দেখি রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা স্টেশনে। তিনি সেখানে কাজ করতেন। সালের কথা আমার ঠিক মনে নেই, তবে সম্ভবত ১৯৫০ সাল হবে। আমি রেডিও পাকিস্তানে কবিতা পাঠের একটি আমন্ত্রণ পাই। আমার নতুন কবিতা কাব্য সংকলনে প্রকাশিত একটি কি দুটি কবিতা আমি রেডিও অফিসে জমা দিই। তখন সাহিত্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন আবুল হোসেন। তিনি কবিতা দুটো পড়ে বললেন, এই কবিতা পড়া যেতে পারে কিন্তু নতুন কবিতা দিলে ভালো হয়। কবিতা দুটিতে জীবনানন্দের প্রভাব ছিল খুবই লক্ষণীয়। 
      আমি কবিতা দু’টি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। তার দুই-একদিন পর আমার লেখা হয়ে গেলে একটি নতুন কবিতা, ‘ওয়াগনে কয়েকটি দিন’ কবিতাটি আমি কবি আবুল হোসেনের কাছে জমা দিই। এই কবিতাটি তিনি গ্রহণ করলেন। এটিই আমার প্রথম কবিতা, যা রেডিওতে পড়ি। কবিতাটিতে জীবনানন্দের প্রভাব ছিল না বললেই হয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই, আবুল হোসেন পরোক্ষে আমার একটি উপকারই করলেন। আমি লেখার ব্যাপারে আরও সচেতন হয়ে উঠলাম। 
     আমার কথা থাক। এখন আবুল হোসেন সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। আবুল হোসেন কোনো কালেই খুব বেশি লেখেননি। কিন্তু কবিতা বিষয়ে ভেবেছেন অনেক বেশি। তিনি তাঁর কবিতাকে কখনও মেদবহুল কিংবা অনর্থক দীর্ঘ করতে চাননি। তাঁর কবিতা এবং সংযম আমাদের কাব্যসাহিত্যে খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। তিনি বেশি লেখেননি। তাঁর বয়সের তুলনায় কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম; কিন্তু যখনই লিখেছেন তাঁর রচনা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে এবং সচেতন পাঠকদের মন কেড়েছে। তাঁর বিষয়ে একটি বৈশিষ্ট্যের কথা না বললেই নয়। তিনি বরাবরই কবিতাকে মুখের কথার খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছেন। এ কাজটি সহজ নয়। এই কঠিন কাজটি তিনি করেছেন সম্পূর্ণভাবে। এই প্রয়াসের ফলে তাঁর কবিতা পাখির পালকের মতোই নির্ভার হয়ে উঠতে পেরেছে। নির্ভার বলে এই কবিতাকে হালকা বলা যাবে না। অনেক গভীর কথাই তিনি বলেছেন সহজ-সরল ভাষায়, যা সংবেদনশীল পাঠকের মনে কাব্যানুভূতি জাগায়। 
      আমি বরাবরই কবি আবুল হোসেনের একজন মনোযোগী পাঠক। তাঁর সবক’টি বই আমি আদ্যোপান্ত পড়েছি। তাঁর কবিতা পড়ার পর যে কথা আমার মনে হয়েছে, তিনি আরও বেশি লিখলে আমাদের কাব্যসাহিত্য সমৃদ্ধতর হতো এবং তাঁর নিজস্ব কাব্যভাণ্ডার তো অধিকতর সমৃদ্ধ হতোই। তবে এ নিয়ে খেদ করার কিছু নেই। সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অনেক কবিই এমন বিরলপ্রজ। তিনি কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত বিদেশি কবিদের বেশকিছু কবিতার রসোত্তীর্ণ অনুবাদ করেছেন। এ ধরনের অনুবাদ যে ভাষায় করা হয়, সে ভাষার কবিতার জন্যও উপকারী। 
       তাঁর সবগুলো গ্রন্থই উল্লেখযোগ্য। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ‘বিরস সংলাপ’ (১৯৬৯), ‘হাওয়া, তোমার কী দুঃসাহস’ (১৯৮২), ‘দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে’ (১৯৮৫), ‘এখনো সময় আছে’ (১৯৯৬) ইত্যাদি। তাঁর কবিতা এক জায়গায় থেমে থাকেনি, তিনি নিজেকে ক্রমাগত বদলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এই পরিবর্তনের স্বাক্ষর তাঁর রচনাসমগ্রে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। সুখের বিষয়, এখনও এই ৭৯ বছর বয়সেও তিনি তাঁর লেখনীকে সচল রেখেছেন। তাঁর এই লেখনী আরও কিছুকাল সচল থাকবে। 
(‘পথিক’ আবুল হোসেন সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০০ (তারেক মাহমুদ সম্পাদিত) থেকে)

Sunday, March 17, 2019

Stopping by Woods on a Snowy Evening (মগরেবের ওক্তে জঙ্গলের কিনারে)


Stopping by Woods on a Snowy Evening
- Robert Frost

Whose woods these are i think i know.
His house is in the village, though;
he will not see me stopping here
to watch his woods fill up with snow.
My little horse must think it queer
to stop without a farmhouse near
between the woods and frozen lake
the darkest evening of the year.
He gives his harness bells a shake
to ask if there is some mistake.
The only other sound's the sweep
of easy wind and downy flake.
The woods are lovely, dark and deep,
But i have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.



মগরেবের ওক্তে জঙ্গলের কিনারে
- খোন্দকার আশরাফ হোসেন


কোন্ মিঞার এই জঙ্গল, মনে লয় জানি
এই মহল্লায় ভি হ্যার হাবেলি অয়া পারে
এই যে খাড়াইছি এইহানে—হালা জানা ভি পারবো না,
দেকবার লইছি ক্যামেন বর্ফে ভরতাছে জংলারে!
আমার ঘুড়াডা ভাবতাছে মাগার ক্যায়া বাত?
ঘরবাড়ি নাইক্কা, মনিব থামলো ক্যালা?
জঙ্গল আর জমুইন্না তালাবের বিচেম
আউজকা বচ্ছরের সবচাইয়া আন্ধাইর্যা রাত!
ঘুড়ায় গলার ঘুণ্টিমে লাড়ান দেয়
যেমুন জিগায় ভুলচুক ঐছে নিকি?
কুছভি সুনা যায় না—খালি বাতাসের আওয়াজ
আর পসমের মাফিক হালকা বর্ফের বাকোয়াজ।
জঙ্গলডা হালায় জবর সোন্দর, আন্ধাইরা গহিন লাগে;
মাগার আমার তো বহুত জবান দেওন আছে—
যাওন লাগব দূরের রাহা নিন্দ যাওনের আগে
যাওন লাগব দূরের রাহা নিন্দ যাওনের আগে।
(রবার্ট ফ্রস্টের Stopping by Woods on a Snowy Evening)

Saturday, March 16, 2019

আল্লামা ইকবালের খুদী সংক্রান্ত কবিতার ২টি লাইনের দুইটি অসাধারণ অনুবাদ

          আল্লামা ইকবালের খুদী সংক্রান্ত কবিতার ২টি বিখ্যাত লাইন হলো: ‘খুুদি কু কর বুলন্দ এতনা কে হর তাকদির সে পেহলে / খোদা বন্দে সে খোদ পূছে বাতা তেরী রেযা কিয়া হ্যায়?’ অর্থাৎ: ``খুদিকে এমন উঁচুতায় নিয়ে যাও যাতে  (তোমার ভাগ্য লিখবার আগে) আল্লাহ স্বয়ং জিজ্ঞেস করেন: বান্দা তোমার সন্তুষ্টি কীসে বল, আমি সেটাই লিখে দেই।" ‘খুদি’ কী? সত্ত্বা তথা আত্মার জাগরণ, সঠিক আত্মোপলব্ধির বলীয়ান বিকাশ। এ খুদিই ইকবালের কাব্যদর্শনের মূল সুর। এ খুদির মাধ্যমে তিনি বিপর্যস্ত মানবতার সংকট-মুক্তির আকুতি জানিয়েছেন। খুদিকাব্যের প্রতিটি ছত্রে তিনি মানবদরদের দূর্গ-কলিজাকে ফালি ফালি করে কেটে পরিবেশন করেছেন আত্মভোলা জাতির দস্তরখানে। আত্মার জাগরণকে তিনি এমন উঁচু স্তরে নিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন, যে স্তরে উন্নীত হলে বান্দার প্রতি আল্লাহপাক সম্পূর্ণই সন্তুষ্ট হয়ে যান। আর সেই সন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ বান্দার তাকদির (ভাগ্যলিপি) বান্দার সম্পূর্ণ অনুকূলেই লিখে দেন। খুদী সংক্রান্ত কবিতার উক্ত ২টি বিখ্যাত লাইনের কাব্য অনুবাদ নীচে দেয়া হলো:

এই দুইটি ভিডিও দেখুন প্লীজ:

বিশেষ নোট: ২য় কাব্য অনুবাদটির কবির নাম আমার জানা নাই। কেউ জানলে এই ই-মেইলে জানাবের প্লীজ: sohelict@gmail.com

Monday, March 11, 2019

ভূগোল শিক্ষা - জুলফিকার ঘোষ


রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতার ২টি অনুবাদ: শীত সন্ধ্যায় বনের কিনারে


Stopping by Woods on a Snowy Evening
- Robert Frost

Whose woods these are i think i know.
His house is in the village, though;
he will not see me stopping here
to watch his woods fill up with snow.
My little horse must think it queer
to stop without a farmhouse near
between the woods and frozen lake
the darkest evening of the year.
He gives his harness bells a shake
to ask if there is some mistake.
The only other sound's the sweep
of easy wind and downy flake.
The woods are lovely, dark and deep,
But i have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.

শীত সন্ধ্যায় বনের কিনারে

        -শামসুর রাহমান 

এই বন কার জানি বলে মনে হয়।
বুঝি বাড়ি তার ঐ গাঁয়ে নিশ্চয়;
জানবে না সে তা দেখছি দাঁড়িয়ে আমি
বন তার হলো এখন তুষারময়।
ঘোরাটা ভাবছে ব্যাপার চমৎকার।

খামার ছাড়াই কী যে লাভ থামাবার,
বন আর এই জমাট হ্রদের মাঝে
আজকে সন্ধ্যা সবচে' অন্ধকার।
ভুল হয়ে গেছে ভেবে সে শব্দ করে

নাড়ায় ঘুন্টি, এবং বনের 'পরে
শুধু আরেকটি শব্দ যাচ্ছে শোনা :
হালকা বাতাসে বরফের কুচি ঝরে।
কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,

কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকি আছে।
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।




তুষার-সন্ধ্যায় বনের কিনারে থেমে

              - জুয়েল মাজহার


কার এই বনভূমি, মনে হয়, আমি চিনি তারে।
বুঝিবা বাড়িটি তার কাছেপিঠে গাঁয়ের ভেতরে;
পড়বে না চোখে তার আমি যে এখানে থামলাম
দেখতে তার বনভূমি ঢেকে যেতে তুষারে তুষারে।


ছোট্ট আমার ঘোড়া হয়তো বা অবাক হয়েছে
কী হেতু এখানে থামা যেহেতু খামার নেই কাছে
দুই পাশে বন আর হ্রদ শুধু বরফ-জমাট
বছরের গাঢ়তম গোধুলি এখানে ঘনায়েছে।
গলতি হয়েছে কোনো এই ভেবে টাট্টু আমার
গলার ঘুন্টিটা সে নাড়লো একবার।
আরো যে শব্দ এক কানে বাজে সেটা
ঝিরিঝিরি হাওয়া আর মিহি তুষারের।

গহনগভীর মধুর কালো এ-বন,
তবু যে আমার রয়েছে একটি পণ,
ঘুমাবার আগে দিতে হবে পাড়ি অনেক যোজন
ঘুমাবার আগে দিতে হবে পাড়ি অনেক যোজন।


[ Stopping by Woods on a Snowy Evening]