Wednesday, March 6, 2019
শায়ের, শায়েরি ও মাহফিলে মুশায়েরা
- রফিকুল ইসলাম রফিক নানা আঙ্গিকের শিল্প-সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শহরের মতো ঢাকারও ছিল মুশায়েরা আয়োজনের ঐতিহ্য। মুশায়েরা হলো উর্দু শেরশায়েরি পাঠের আসর। এ মাধ্যম উর্দু কাব্য-আন্দোলনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করে। ঢাকা একসময় উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের চর্চার জন্য ছিল বিশেষভাবে খ্যাত। যখন কোনো সাহিত্য পত্রিকা ছিল না, তখন এই মুশায়েরা পাঠের আয়োজনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ কাব্যচর্চার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেত। মজার বিষয়, অক্ষরজ্ঞানহীন শায়েররাও এ কাব্য সভায় উপস্থিত হয়ে অনর্গল উর্দু শের উপস্থাপন করতেন। এ কাব্যসভায় উপস্থিত থাকতেন কয়েকজন বিচারক। সভার সভাপতিকে মির মুশায়েরার বলা হতো। কবিতা বা শেরশায়েরি পাঠকের সামনে শামাদানে রাখা হতো মোমের প্রদীপ। মুশায়েরা অনুষ্ঠানে যেসব শেরশায়েরি জনপ্রিয় হতো, সেগুলো পরে পত্রিকায় প্রকাশ করে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হতো। এ ছাড়া মুখে মুখে কাব্যের প্রসারে মুশায়েরা অনুষ্ঠান অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত আদব-কায়দা ছিল অত্যন্ত মার্জিত ও সুশৃঙ্খল। এবার ঢাকার সে সময়ের জনপ্রিয় একটি শায়েরির কয়টি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যাক : ‘বেতাবি কাহ রাহি হায়/ চালো কুয়ে ইয়ার মে/ সিমার কি তারাক হয়ে/দেলে (দিল) বেকারার মে।’ অর্থাৎ অস্থির হৃদয় বলছে চল প্রিয়ার কোঠায়। পারদের প্রদাহ আছে আমার অস্থির মনে। সমকালীন শহুরে পরিবেশে মুশায়েরা বুদ্ধিবৃত্তিক চিত্তবিনোদনের সর্বাপেক্ষা মার্জিত অনুষ্ঠান বলে পরিচিতি লাভ করে। গজল রচনার সঙ্গেও মুশায়েরা অনুষ্ঠানটি ছিল সম্পর্কিত। ঢাকায় ঘরে ঘরে একসময় উর্দু পাহেলি বলার প্রচলন ছিল। পাহেলি বলতে বোঝানো হতো ধাঁধাকে। ঢাকাইয়া মানুষের মুখে মুখে একসময় পাহেলি বলার চল ছিল, বসত এর আসরও। ঢাকায় প্রচলিত দুটি পাহেলি ছিল : ১. কালি মুরগি কালাম তারাস/ আণ্ডা দেবে শ ও পচাশ। অর্থাৎ মাখনা। এবং ২. ওস পার সে আয়ি গৌরী/ ওসপে হ্যায় রেশম কি ডোরি/ খোদ দৌড়তি, লোগকো দৌওরাতি। অর্থাৎ ঘুড়ি।
মুশায়েরা আয়োজন মোগল আমলেই উৎকর্ষ লাভ করে, পায় ব্যাপক প্রসার। ঢাকায় একসময় কবি মির্জা গালিবের ছিল অসংখ্য গুণগ্রাহী। উর্দু ভাষার জনাকয়েক কবি তাঁর সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ করতেন। অনেকে তাঁর সানি্নধ্যেও এসেছিলেন। নওয়াব শামসুদদৌলাহ ছিলেন উর্দু সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি মুশায়েরার আয়োজন করতেন। তাঁর আয়োজিত বৈঠকের একটি শের মানুষের মুখে মুখে ফিরত : ‘মোহাব্বত মে এক এয়সা বক্ত ভি আতা ইনসাঁ পর/ সিতারো কি চমক সে চোট লাগতি হ্যায় রগেঁজা পর।
আহসান মঞ্জিলের নবাব পরিবারও মুশায়েরার জন্য খ্যাত। নবাব আহসান উল্লাহ কাব্যপ্রেমিক এবং তিনি নিজে উর্দু ও ফারসি কবিতা রচনা করতেন। করতেন মুশায়েরার আয়োজন। নবাব আবদুল গনি ছিলেন সংগীতপ্রেমী মানুষ। তাঁর দরবারে গজল এবং নাতের আসর বসত। নবাব গনি মহররম মাসে শহীদে কারবালার স্মরণে মর্সিয়া, সালাম, কাশিদা, নাত, নওহা ইত্যাদি পাঠের জন্য কবিদের উৎসাহিত করতেন। নানা উৎসব উপলক্ষেও আহসান মঞ্জিলে জাঁকজমকের সঙ্গে মুশায়েরা অনুষ্ঠিত হতো।
আশরাফউজ্জামান তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন, তা এ রকম : ‘ঢাকার রইস সম্প্রদায়ের ভাষাও ছিল উর্দু। কাজেই উর্দু ভাষা নিয়ে ঈদের দিনে কবিতার আসর জমে উঠত আহসান মঞ্জিলে। কবিরা এক এক লাইন করে কবিতা আওড়াতেন। আর শায়েরা বাহ, বাহ, মারহাবা, মারহাবা_মাশাআল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠতেন। বেগম সাহেবরা অন্দরমহল থেকে আসরে পাঠাতেন জাফরানি শবরত এবং ইরাকি খেজুর। দুধযোগে কাশ্মীরি চা-ও আসত সঙ্গে।’ নবাব খাজা আহসান উল্লাহ শাহীনের একটি শায়েরির কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন : ‘দেল খোশহো কে ফাসলে গুল, গুলিস্তাঁমে ফের আয়ি হায়/ নাওয়েদে আয়েশ ও ইসরাত ফের সাবা গুলশান মে লায়ি হায়।/ খিলে হায় ফুল বো কালমুমে নহরে হার তরপ জারি/ মায় ইসরাত পেলাসাকি, ঘটাভি শার পেছায়ি হায়।
সৈয়দ মোহাম্মদ বাকের, তাবতা বাই ও আগা জানই রানি ফারসি ভাষার উঁচু স্তরের কবি ছিলেন। প্রতি মাসে তাঁদের বাসভবনে ফারসি মুশায়েরার আসর বসত। কয়েকটি ঢাকাইয়া পরিবারে নিয়মিত মুশায়েরার আসর বসত। হাকিম হাবিবুর রহমানের বাসভবনে প্রতি মাসে একবার মুশায়েরার আসর বসত। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে মুশায়েরার আয়োজন করা হতো। মুশায়েরার পঠিত শেরশায়েরির মধ্য থেকে বাছাই করা শের ‘গুলদাস্তা’ নামের কাব্য পত্রিকায় প্রকাশ করে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হতো। কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোনো এক মাঘী পূর্ণিমায় হাকিম সাহেবের বাড়ির ছাদে এক মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। নজরুলের গজল ও ইসলামী গান শোনার জন্য শহরের গণ্যমান্য ও সংগীতজ্ঞ বহু লোক এ সভায় এসেছিলেন। হাকিম সাহেবের মুশায়েরায় নবাববাড়ির কবিরাও অংশ নিতেন।
ঢাকার বকশিবাজারের হজরত হাফেজ জহুরুল হক মোবারকির বাসভবনে নিয়মিত মুশায়েরার আসর বসত। এখানে ড. আন্দালিব শাদানীসহ উপমহাদেশের অনেক কবি মুশায়েরায় অংশগ্রহণ করতেন। পাকিস্তান আমলে ঢাকার নিমতলীর রেডিও পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ বেতার) থেকে প্রচারিত মুশায়েরা অনুষ্ঠানে সমাজের বিশিষ্ট কবি এবং সহিত্যিকরা উপস্থিত থাকতেন।
‘গুলিস্তানে-এ শরফ’ গ্রন্থের লেখক সৈয়দ শরফউদ্দীন শরফ আল হুসাইনী তাঁর বেগমবাজারের বাসভবনে মুশায়েরার আসর জমাতেন। উর্দু কবি নওশাদপুরী তাঁর বাসভবনে মুশায়েরার আয়োজন করতেন। এখানে উর্দু ভাষাভাষি লোকজন ছাড়াও বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার, উর্দু সাহিত্যপ্রেমিক মরহুম আলহাজ মোহাম্মদ সাখী মিয়াও প্রায়ই মুশায়েরার আয়োজন করতেন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment