- শা ম সু র রা হ মা ন
আবুল হোসেন চল্লিশের দশকের একজন উজ্জ্বল কবি। মুসলিম সমাজে যখন আধুনিক কবিতার মুখ লক্ষ্য করা যায় নি, তখন আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর কাব্য প্রতিভায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাংলা কবিতা। আমি মনে করি, কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য সাধনা মুসলিম কবিদের আধুনিক কবিতার দিকে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম যে ক’জন তরুণ মুসলিম কবি আধুনিক কবিতা লেখার ব্যাপারে আগ্রহী হলেন, তাঁরা—আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস এবং আবুল হোসেন। এদের পরে এলেন সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক এবং অন্যান্য কবি।
আমি আবুল হোসেনের কবিতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন নামজাদা পত্রিকায় পড়ি। তখন থেকেই আমি তাঁর একজন অনুরক্ত পাঠক।
আবুল হোসেনকে আমি প্রথম দেখি রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা স্টেশনে। তিনি সেখানে কাজ করতেন। সালের কথা আমার ঠিক মনে নেই, তবে সম্ভবত ১৯৫০ সাল হবে। আমি রেডিও পাকিস্তানে কবিতা পাঠের একটি আমন্ত্রণ পাই। আমার নতুন কবিতা কাব্য সংকলনে প্রকাশিত একটি কি দুটি কবিতা আমি রেডিও অফিসে জমা দিই। তখন সাহিত্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন আবুল হোসেন। তিনি কবিতা দুটো পড়ে বললেন, এই কবিতা পড়া যেতে পারে কিন্তু নতুন কবিতা দিলে ভালো হয়। কবিতা দুটিতে জীবনানন্দের প্রভাব ছিল খুবই লক্ষণীয়।
আমি কবিতা দু’টি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। তার দুই-একদিন পর আমার লেখা হয়ে গেলে একটি নতুন কবিতা, ‘ওয়াগনে কয়েকটি দিন’ কবিতাটি আমি কবি আবুল হোসেনের কাছে জমা দিই। এই কবিতাটি তিনি গ্রহণ করলেন। এটিই আমার প্রথম কবিতা, যা রেডিওতে পড়ি। কবিতাটিতে জীবনানন্দের প্রভাব ছিল না বললেই হয়। আমার বলতে দ্বিধা নেই, আবুল হোসেন পরোক্ষে আমার একটি উপকারই করলেন। আমি লেখার ব্যাপারে আরও সচেতন হয়ে উঠলাম।
আমার কথা থাক। এখন আবুল হোসেন সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। আবুল হোসেন কোনো কালেই খুব বেশি লেখেননি। কিন্তু কবিতা বিষয়ে ভেবেছেন অনেক বেশি। তিনি তাঁর কবিতাকে কখনও মেদবহুল কিংবা অনর্থক দীর্ঘ করতে চাননি। তাঁর কবিতা এবং সংযম আমাদের কাব্যসাহিত্যে খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। তিনি বেশি লেখেননি। তাঁর বয়সের তুলনায় কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা খুব কম; কিন্তু যখনই লিখেছেন তাঁর রচনা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে এবং সচেতন পাঠকদের মন কেড়েছে। তাঁর বিষয়ে একটি বৈশিষ্ট্যের কথা না বললেই নয়। তিনি বরাবরই কবিতাকে মুখের কথার খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে চেয়েছেন। এ কাজটি সহজ নয়। এই কঠিন কাজটি তিনি করেছেন সম্পূর্ণভাবে। এই প্রয়াসের ফলে তাঁর কবিতা পাখির পালকের মতোই নির্ভার হয়ে উঠতে পেরেছে। নির্ভার বলে এই কবিতাকে হালকা বলা যাবে না। অনেক গভীর কথাই তিনি বলেছেন সহজ-সরল ভাষায়, যা সংবেদনশীল পাঠকের মনে কাব্যানুভূতি জাগায়।
আমি বরাবরই কবি আবুল হোসেনের একজন মনোযোগী পাঠক। তাঁর সবক’টি বই আমি আদ্যোপান্ত পড়েছি। তাঁর কবিতা পড়ার পর যে কথা আমার মনে হয়েছে, তিনি আরও বেশি লিখলে আমাদের কাব্যসাহিত্য সমৃদ্ধতর হতো এবং তাঁর নিজস্ব কাব্যভাণ্ডার তো অধিকতর সমৃদ্ধ হতোই। তবে এ নিয়ে খেদ করার কিছু নেই। সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে অনেক কবিই এমন বিরলপ্রজ। তিনি কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত বিদেশি কবিদের বেশকিছু কবিতার রসোত্তীর্ণ অনুবাদ করেছেন। এ ধরনের অনুবাদ যে ভাষায় করা হয়, সে ভাষার কবিতার জন্যও উপকারী।
তাঁর সবগুলো গ্রন্থই উল্লেখযোগ্য। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘নববসন্ত’ (১৯৪০), ‘বিরস সংলাপ’ (১৯৬৯), ‘হাওয়া, তোমার কী দুঃসাহস’ (১৯৮২), ‘দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে’ (১৯৮৫), ‘এখনো সময় আছে’ (১৯৯৬) ইত্যাদি।
তাঁর কবিতা এক জায়গায় থেমে থাকেনি, তিনি নিজেকে ক্রমাগত বদলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এই পরিবর্তনের স্বাক্ষর তাঁর রচনাসমগ্রে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। সুখের বিষয়, এখনও এই ৭৯ বছর বয়সেও তিনি তাঁর লেখনীকে সচল রেখেছেন। তাঁর এই লেখনী আরও কিছুকাল সচল থাকবে।
(‘পথিক’ আবুল হোসেন সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০০০ (তারেক মাহমুদ সম্পাদিত) থেকে)
No comments:
Post a Comment