লিটল ম্যাগ কালচারঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ ।
- প্রবীর বিকাশ সরকার
লিটল ম্যাগাজিন। আদর করে অনেকে বলেন ‘লিটল ম্যাগ’ বা ‘লিট ম্যাগস’ নামে। যার অর্থ আদতেই ক্ষুদ্র সাহিত্যকোষ। বাংলায় ছোট কাগজ। কী অর্থে ছোট? সেটা সুস্পষ্ট নয়। সেই তো ঢাউস-ঢাউস সাহিত্য ম্যাগাজিনও বের হয়েছে এবং হচ্ছে। কলকাতার বিখ্যাত ছোট কাগজ ‘অনুস্টুপ’ এর পূজা সংখ্যা এতই বিপুলÑ মেদবহুল যে হাতের মুঠোয় ধরে না! প্রকৃতপক্ষে, কোন্ মানদণ্ডে ছোট কাগজ তা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। মূলত প্রথাবিরুদ্ধ একটি আন্দোলন ছিল এই লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ। যাতে নতুন বা অখ্যাত কবিরাই কবিতা লিখবেন এবং অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে। লক্ষ্য : কবিতাকে পণ্য করা যাবে না। পরবর্তীকালে এই গণ্ডি ভেঙ্গে গেছে সংযুক্ত হয়েছে প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র, সাক্ষাতকার, গ্রন্থালোচনা, শিল্পকলা আরও কত কী!
‘লিটল ম্যাগাজিন’ শব্দটি বাংলায় কবি বুদ্ধদেব বসু প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ১৯৫৩ সালের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ কাগজের মে সংখ্যায় প্রকাশিত তার ‘সাহিত্যপত্র’ নামক প্রবন্ধে। মনে হয় কোনক্রমে মার্কিন দেশীয় লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় সাহিত্য কাগজ তার হাতে এসে থাকবে বা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের খবর তিনি পেতেন। তারপর তো পঞ্চাশের দশকে তিনি আমেরিকাতেই গেলেন অতিথি অধ্যাপক হিসেবে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়াতে তখন স্বচক্ষে লিটল ম্যাগাজিন প্রত্যক্ষ করেছেন বলাই যায়।
লিটল ম্যাগাজিন প্রথম কী আমেরিকায় প্রকাশিত হয়েছিল? সঠিক জানা নেই, তবে অনেকে মনে করেন আঠারো শতকের মাঝামাঝি আমেরিকার বোস্টন শহর থেকে প্রকাশিত ‘ডায়াল’ (১৮৪০-৪৪) কাগজটিই প্রথম লিটল ম্যাগ। এটা সম্পাদনা করেছিলেন যৌথভাবে যথাক্রমে শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক রেলফ ওয়ালডো এমারসন এবং সারা মার্গারেট ফুলার অসোলিÑ তিনি ছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, নারীবাদী কর্মী এবং আমেরিকার প্রথম পরিপূর্ণ গ্রন্থ পর্যালোচক। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে লিটল ম্যাগ প্রকাশ করেন কবি ও সমালোচক আর্থার সাইমন ‘দি সেভয়’ নামে।
বিংশ শতাব্দীতে লিটল ম্যাগাজিনের জগতে প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ‘দি মাসেস’ (জনসাধারণ) নামে একটি কাগজের উত্থান। এটা নিউইয়র্কে প্রকাশিত হয়েছিল তরুণ এক গবেষকের দ্বারা তার নাম ম্যাক্স ইস্টম্যান অবশ্য মূল উদ্যোক্তা ছিলেন এক খেয়ালী বামপন্থী ওলন্দাজ অভিবাসী পিয়েট ভেøগ। এই ম্যাগাজিন নিয়ে মামলাও হয়েছিল সাম্যবাদী বিষয়বস্তুর কারণে। নিষিদ্ধও হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে ‘দি লিবোরেটর’ এবং ‘দি নিউ মাসেস’ নামে পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল, চালু ছিল ১৯১১-১৭ পর্যন্ত। আরও উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ১৯১২ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে প্রকাশিত হয় প্রভূত শক্তিশালী লিটল ম্যাগ ‘পোয়েট্রি : এ ম্যাগাজিন অব ভার্জ’- এটা সম্পাদনা করতেন কবি হেরিয়েট মনরয়ে এবং বিদেশী সম্পাদক হিসেবে প্রভাবশালী কবি এজরা পাউন্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে (১৯১৪-১৮) আরও একাধিক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয় আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিভিন্ন শহরে যেমন শিকাগো, নিউইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো ও প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘দি লিটল রিভিউ’ নামক একটি ম্যাগাজিনের কথা জানা যায় যেটা ১৯১৪-২৯ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, সম্পাদনা করেছেন মার্গারেট কেরোলিন এন্ডারসন নামে একজন খ্যাতিমান লেখিকা। এটা খুব প্রভাবশালী সাহিত্য কাগজ ছিল। এতে লিখে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছেন কবি এজরা পাউন্ড, কবি টি এস ইলিয়ট, কবি ও উপন্যাসিক জেমস জয়েস, কবি রবার্ট ফ্রস্ট প্রমুখ। ১৯১৪-১৯ পর্যন্ত ‘দি ইগোয়িস্ট’ নামে একটি কাগজ প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনে সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে সাংবাদিক ও দর্শনবিষয়ক লেখিকা ডোরা মার্সডেন এবং রাজনৈতিক নারী নেত্রী ও সম্পাদক হেরিয়েট শোও ইউভার। ১৯১৫-১৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ‘আদারস্’ সম্পাদনা করেছেন কবি আলফ্রেড ক্রেমবর্গ। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপে যেমন ‘মডার্ন রিভিউ’ (১৯২২-১২৪), ‘দি ফিউজিটিভ’ ১৯২২-২৫), ‘ভয়েসেস’ (১৯২১-৬৫), ‘সেশন’ (১৯২২-২৪) ‘ব্রুম’ (১৯২১-২৪), ‘দিস কোয়ার্টার’ (১৯২৫-৩২), ‘দি এনিমি’ (১৯২৭-২৯), ‘দি মিডল্যান্ড’ (১৯১৫-৩৩), ‘দি ফ্রন্টিয়ার’ (১৯২০-৩৯) ‘সাউথওয়েস্ট রিভিউ’ (১৯২৪), ‘ডাবল-ডিলার’ (১৯২১-২৬), ‘দি এনভিল’ (১৯৩৩-৩৫), ‘ব্লাস্ট’ (১৯৩৩-৩৪), ‘দি পার্টিশান রিভিউ’ (১৯৩৩), ‘ট্রানজিশন’ (১৯২৭-৩৮), ‘নিউ ভার্জ’ (১৯৩৩-৩৯), ‘ক্রাইটেরিয়ন’ (১৯২২-৩৯) উল্লেখযোগ্য।
এশিয়ার জাপান এবং ভারতবর্ষেও লিটল ম্যাগ আন্দোলন বিশেষ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। জাপানে লিটল ম্যাগাজিনকে বলা হয় ‘দোওজিনশি’, এদেশে প্রথম যে লিটল ম্যাগটির সংবাদ পাওয়া যায় সেটি সাধারণ সাহিত্যভিত্তিক নাম ‘গারাকুতা বুনকো’ ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। এতে হাইকু, তানকা কবিতার সঙ্গে ছোটগল্পও ছিল। এটা প্রকাশ করেছিলেন কয়েকজন কবি ও সাহিত্যিক মিলে এঁরা হলেন ঔপন্যাসিক ওজাকি কোওয়োও, কবি, সাহিত্যিক ও সমালোচক ইয়ামাদা বিমিয়োও, ঔপন্যাসিক ইশিবাশি সিআন এবং কবি মারুওকা কিউকা তারা ‘কেনইউশা’ নামে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ‘বুনগাকুকাই’ সাহিত্য কাগজ তাতে খ্যাতিমান সাহিত্যিক শিমাজাকি তোওসোন, ঔপন্যাসিক হিগুচি ইচিয়োও, কবি হিরাতা তোকুবোকু প্রমুখ লিখতেন। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘শিনশিচোও’- এই গোষ্ঠীতে ছিলেন বিশ্বখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক আকুতাগাওয়া রিইউনোসুকেসহ খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কিকুচি হিরোশি, হাইকু কবি, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার কুমে মাসাও প্রমুখ। ১৯১০ সালে বের হয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী লিটল ম্যাগ ‘শিরাকাবা’ এটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রভাবশালী কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রভক্ত মুশাকোজি সানেআৎসু, ঔপন্যাসিক শিগে নাওইয়া, কবি কিনোশিতা রিনগে প্রমুখ। ১৯২৩ পর্যন্ত কাগজটি চালু ছিল। অন্য দুটো সাহিত্য কাগজ আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বিগত শতবর্ষ ধরে জাপানে সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, নাটক ও শিল্পকলার বহু লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে, ঝরে গিয়েও এখনও বেশকিছু টিকে আছে। বিশেষ করে কবিতাপত্র ‘গেনদাইশি’ খুবই ঋদ্ধ একটি লিটল ম্যাগ এবং ব্যাপক জনপ্রিয়। হাইকুভিত্তিক লিটল ম্যাগও একাধিক প্রকাশিত হচ্ছে। জাপানী সাহিত্য এক বিশাল জগত, সেই বিপুল বৈচিত্র্যময় জগতের অনেক কীর্তিমান কবি ও সাহিত্যিকই লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করেছেন এবং এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে গেছেন। জাপানে সবাই হাইকু লিখতে জানে। তানকা কবিতা লেখার চর্চাও সুবিস্তৃত। ফলে উচ্চবিদ্যাপীঠগুলো থেকে প্রচুর লিটল ম্যাগ প্রকাশ করে ছাত্রছাত্রীরা।
ভারত উপমহাদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল গবেষণাসাপেক্ষ। কেউ কেউ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’, অনেকে মনে করেন কথাশিল্পী প্রমথ চৌধুরীর সুসম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ সাময়িকী ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের প্রথম সাহিত্যবিষয়ক লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ। তবে মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপেডিয়ার কল্যাণে জানা যাচ্ছে যে, অবিভক্ত বাংলার লিটল ম্যাগ আন্দোলন অনন্য এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই ধারা প্রভাবিত করেছে পঞ্চাশের দশকে মারাঠি সাহিত্য এবং ষাটের দশকে বোম্বের সাহিত্য জগতকে। হিন্দি, উর্দু এবং অসমীয় সাহিত্যিকদেরও নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। ১৯২৩ সালে কলকাতায় ‘কল্লোল’ সাহিত্য কাগজকে কেন্দ্র করে সূচিত হয় লিটল ম্যাগ আন্দোলন। আধুনিক কবি যথাক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। ১৯৩০ সালের দিকে প্রকাশিত হয় প্রবাদপ্রতিম আধুনিক কথাসাহিত্যিক কবি বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত ‘কবিতা’, তারও আগে ১৯২৯ সালে ঢাকায় কবি অজিত দত্তের সঙ্গে ‘প্রগতি’ সম্পাদনা করেন প্রথমে হাতে লিখে; কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বের করেন ‘পরিচয়’ প্রভৃতি। এরপর একাধিক ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শনিবারের চিঠি, সওগাত, শিখা, কালিকলম, পূর্বাশা, চতুরঙ্গ প্রভৃতি।
পঞ্চাশের দশকে ভূমিকম্পের মতো নাড়া দিল দুই বাংলার সাহিত্য জগতকে ‘কৃত্তিবাস’ কাগজ, শক্তিশালী তরুণ কবি যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী, দীপক মজুমদার প্রমুখ এর উদ্যোক্তা। কিন্তু ‘কৃত্তিবাস’কে ছাড়িয়ে ধূমকেতুর মতো ঝড় তুলল তাদেরই সমবয়সী কবি ও সাহিত্যিক সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় প্রমুখ মিলে অভিনব সাহিত্য আন্দোলন ‘হাঙরি জেনারেশন’ বা ‘হাঙরি আন্দোলন’ ষাট দশকের প্রথম দিকে। তাদের মুখপত্র ছিল ‘হাওয়া ৪৯’ নাম একটি কাগজ।
আমার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের প্রথম পরিচয় ১৯৭৬ সালে। এর আগে জানতাম না এই সম্পর্কে, অবশ্য দরকারও পড়েনি। তখন খুব শুনতাম ‘সংকলন’ শব্দটি। তাতে থাকে কবিতা, ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ। কোন কোনটা ছড়ার সঙ্কলন, কোনটা কবিতার, কোনটা গল্পের ইত্যাদি। কিন্তু সঙ্কলন আর ছোটকাগজ মনে হয় এক জিনিস নয়। যদিওবা দুটোই মুদ্রিত জিনিস। সঙ্কলনের মধ্যে চিন্তা ও সময়ের সীমাবদ্ধতা অনুভূত হয় যা নয় ছোটকাগজে-তাতে সমুদ্রেরও গভীরতা খুঁজে পাওয়া যায়। বহু মহৎ রচনা ছোটকাগজের কল্যাণে পাঠকসমাদৃত হয়েছে যুগে যুগে।
সাহিত্যের ইতিহাস থেকে জানা যায় দেশে-বিদেশে যুগে যুগে বড় বড় কবি ও লেখকরা লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ থেকেই উঠে এসেছেন প্রতিষ্ঠার মঞ্চে। আমি যা লিখেছি ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত খুব কমই লিটল ম্যাগে লিখেছি তবে জাতীয় দিবসভিত্তিক ছড়া সঙ্কলনে বেশ ছড়া লিখেছি একসময়, তখন সেটা একটা রীতি গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর। অবশ্য আমি বড় কোন কবি বা লেখক নই। হওয়ার ইচ্ছেও নেই। রাজা হয়ে গেলে রাজকীয় ঝামেলা-ঝক্কিও অনেক। নিচু হয়ে থাকাই নিরাপদ ও বন্ধুসুলভ।
তাই বলে লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ পড়ি না তা নয়, বরং আমার যথেষ্ট স্নেহ ও দুর্বলতা আছে এই প্রকাশনা মাধ্যমটির জন্য কৈশোর থেকেই। জানি না ঠিক কেন? জাপানেও বিস্তর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়ে থাকে আগেই বলেছি। প্রচুর কবি, লেখক ও সাহিত্যিক এগুলোতে লিখে থাকেন। প্রচার সংখ্যাও হাজার হাজার। বিশেষ করে কবিতা ও চিত্রকলার ছোটকাগজগুলো অসাধারণ! অধিকাংশই ইনার পেজ সাদাকালো তবে প্রচ্ছদ ও বিজ্ঞাপনগুলো বহুরঙা। প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাগগুলো বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে। বৈচিত্র্যময়, সুখপাঠ্য কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ থাকে অনেক। সঙ্গে মনোহরা রঙিন ও সাদাকালো অঙ্কন, ইলাস্ট্রেশন। অনেক লিটল ম্যাগকে স্বল্পায়ু নিয়ে হারিয়ে যেতেও দেখেছি। জাপানে একটি জিনিস খুব সহজলভ্য সেটা হলো কাগজ। কত বিচিত্র রঙের ও রকমের কাগজ যে এদেশে আছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী ‘ওয়াশি’ নামে খসখসে হাল্কা চমৎকার কাগজ রয়েছে একটু ব্যয়বহুল হলেও তাতে রঙিন অঙ্কন ও মুদ্রণের কারণে আলাদা একটা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কাগুজে বৈচিত্র্যের কারণে জাপানের লিটল ম্যাগগুলো দেখতে যেমন চোখে আরাম লাগে তেমনি সংরক্ষণ করতেও ভাল লাগে।
বাংলাদেশের প্রতিটি শহরের আনাচে কানাচে লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়ে থাকে। লেখায় ও রেখায় অবশ্যই সমৃদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনভাবে নিজস্ব মত প্রকাশ এবং হাত মকশো করার জন্য লিটল ম্যাগ নিরাপদ মাধ্যম। অবশ্য বিপদের আশঙ্কা যে একেবারে নেই তা নয়, তা নির্ভর করে সময় ও পরিস্থিতির ওপর। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়। লিটল ম্যাগ পুরস্কারও প্রদান করা হয় সরকারীভাবে। ২০০৭ সালে নন্দন চত্বরে জাতীয় লিটল ম্যাগ মেলা দেখে বিস্মিত হয়েছি প্রাচুর্যতার কারণে! ওখানে বহু লিটল ম্যাগ এখনও সিল্ক স্ক্রিন প্রিন্ট পদ্ধতিতে ছাপা হয় তাই উৎকট একটা গন্ধ থাকে যেটা ভাল লাগে না। তবে লেখাগুলো ভাবনার উদ্রেক করে। অনেক লিটল ম্যাগ আমি একাধিকবার কিনে নিয়ে গিয়েছি জাপানে দুই বাংলা থেকে। বন্ধুদের বিলিয়ে দিয়েছি।
পাক আমল এবং স্বাধীনতার পর ঢাকাতেও লিটল ম্যাগ আন্দোলন হয়েছিল, বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়েছে যেমন মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, সমকাল, স্যাড জেনারেশন, স্বাক্ষর, কণ্ঠস্বর, সাম্প্রতিক, উত্তরণ, সুন্দরম, না, পূর্বমেঘ, দ্রষ্টব্য, বিপ্রতীক, নিসর্গ, একবিংশ, চালচিত্র, কিছুদিন রৌত্রের মুখোমুখি, রূপম, শিল্পতরু, স্বকাল, চর্যাপদ, সুতরাং, অক্ষর, অরিত্র, অর্কেস্ট্রা, আজকের কবিতা আড্ডা, আশির দশক, ঈষিকা, উলুখাগড়া, উল্লেখ, উন্মেষ, ঊষালোক, উটপাখি, ঋগ্বেদ, এবংবিধ, এ্যান্টিক্লক, এষণা, ওঙ্কার, কর্ষণ, কহন, সুবিল, কাশপাতা, কালধারা, ক্রম, দাহপত্র, লেখাবিল, ক্রান্তিক, কবিকণ্ঠ, ক্যাথরসিস, কিউপিড, থার্ডম্যাগ, দোআঁশ, নদী, কোরাস, কারুজ, দ্যুতি, খেয়া, গন্ধম, ঘাস, ঘুড্ডি, চিহ্ন, জীবনানন্দ, সূর্যঘুড়ি, নান্দীপাঠ, শব্দপাঠ, প্রাকৃত, পুন্ড্র, উল্লেখ, পথরেখা, প্রমা, পরাবাস্তব, প্রাতিস্বিক, পুষ্পকরথ, ব্যস, ব্রাত্য, ব্যতিক্রম, মধ্যাহ্ন, লোকায়ত, লাস্টবেঞ্চ, শুদ্ধস্বর, শিরদাঁড়া, সুনৃত, জংসন, মঙ্গলসন্ধ্যা, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, শব্দশিল্প, শতদ্র, পূর্ণদৈর্ঘ্য, অলক্ত, ১৪০০, দ্বিতীয় চিন্তা, কবিতাপত্র, দুয়েন্দে, তারুণ্য, কিছুধ্বনি, প্রচ্ছদ, প্রাক্সিস জার্নাল, গান্ডিব, সিম্ফনী, নতুন কবিতা, ঢেউ, সূচীপত্র, চারিত্র, প্রতিশিল্প, ছোটকাগজ, বৈঠা প্রভৃতি। গুণেমানে সমৃদ্ধ ম্যাগাজিনের জন্য বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার ঘোষণা করে উৎসাহ দিয়েছেন। ‘ছোটকাগজ’ থেকে প্রথম কবিদের স্বকণ্ঠে আবৃত্তিকৃত কবিতার ক্যাসেটও প্রকাশিত হয়েছিল যা নতুন একটি উদ্যোগ বলা যায়।
একসময় চট্টগ্রামকে বলা হতো লিটল ম্যাগের রাজধানী। বহু ম্যাগাজিন রূপেবৈচিত্র্যে ও মনআনচান করা লেখায় প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি। স্বাধীনতার পরপর ‘স্পার্ক জেনারেশন’ সাহিত্য আন্দোলন ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। নেতৃত্বে ছিলেন কবি কমল সেনগুপ্ত, স্বপন দত্ত, শিশির দত্ত প্রমুখ। কালপুরুষ, এইদিন সেইদিন, রক্তিম ফাগুন, প্রতিরোধ, শিরোনাম, যতদিন পৃথিবীতে, পদক্ষেপ, ধ্রুবপদ, ক্রান্তিক, ষড়ঋতু, অন্যব্রত, অন্যস্বর, দাঁড়কাক, বোধ, অথৈ, প্রমুক্ত বালার্ক, অক্ষোহিনী, অচিন পাখি, রানার, ধ্রুপদ, চর্যা, কালধারা, দ্রৌপদী প্রভৃতি লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের তরুণ চিত্রশিল্পীরা নতুন একটি মাত্রা এনেছিলেন বেশকিছু ছোটকাগজের প্রচ্ছদে হাতেলেখা নামের অলঙ্করণে। ইলাস্ট্রেশন ছিল আকর্ষণীয়। সেই ছোটকাগজ সংস্কৃতির যৌবন এখন ঝুলে গেছে, নিবু নিবু, ম্রিয়মাণ। সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোর পাতাগুলো ঠোঙা বা চানাচুর আর বাদামের মোড়ক, কিংবা রেস্টুরেন্টের প্লেট ও হাত মোছার ন্যাপকিনস্বরূপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে কবেই!
জাপানে যেভাবে মুদ্রিত বস্তু এবং প্রকাশনাগুলো সংরক্ষণ হয়ে থাকে সরকারী ও বেসরকারীভাবে তা কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতে হয় না। জাপানে ‘পোস্টার শিরিয়োওকান’ বা ‘পোস্টার জাদুঘর’ যেমন আছে তেমনি আছে প্রচারপত্র বা হ্যান্ডবিল সংরক্ষণ জাদুঘর পর্যন্ত। আবার সারাদেশে আছে অসংখ্য সাহিত্য জাদুঘর। খুবই আশ্চর্য হয়েছি যে, টোকিওর কুদানশিতা শহরে অবস্থিত একটি রাস্তার পাশে একটি স্মৃতিফলক দেখতে পেয়ে। ১৯৯২ সালে স্থাপিত ফলকটিতে জাপানের প্রথম যে লিটল ম্যাগ ‘গারাকুতা বুনকো’ প্রকাশ করেছিল সেই সাহিত্যগোষ্ঠী ‘কেন্ইউশা’র ইতিবৃত্তি লেখা আছে অর্থাৎ ‘কেন্ইউশা’ নামে আধুনিক জাপানের সূচনাকালের একটি সাহিত্যগোষ্ঠী এখানে অবস্থিত ছিল তার স্মারকচিহ্ন এটা। ফলে এ দেশের অগণিত কবি, সাহিত্যিক ও গবেষক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি হারিয়ে যায় না যেটা হরহামেশা হারিয়ে যাচ্ছে উপমহাদেশে। কত কবি, লেখক ও সাহিত্যিক আর মূল্যবান রচনা, ইতিহাস, ঘটনা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছেও প্রতিদিন কে তার হদিশ রাখে? তবে আশার কথা যে কলকাতায় কবি সন্দীপ দত্ত এবং বাংলাদেশে সাজ্জাদ বিপ্লব লিটল ম্যাগ বা ছোটকাগজ সংগ্রহ করে চলেছেন এবং গড়ে তুলছেন সংগ্রহশালা। বগুড়া জেলায় সাজ্জাদ গড়ে তুলেছেন ‘পুন্ড্রনগর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি’ নামে একটি জাদুঘর।
বেশ কয়েক বছর আগে কুমিল্লা শহরের জগতখ্যাত রামমালা গ্রন্থাগারে অসংখ্য লিটল ম্যাগ দেখেছিলাম এলোমেলোভাবে টেবিলের ওপর স্তূপ হয়ে আছে। পুরনো যেমন ছিল তেমনি আনকোড়া নতুন কাগজও ছিল। যেমন পূর্বাশা, অলক্ত, আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী, সে আমি তুমি, অশ্রু হলো বারুদ, আপন, কমলাঙ্ক, জাগৃতি, রংধনুসহ অনেক ঋতুভিত্তিক কৃশকায় সাহিত্য সঙ্কলনও। এগুলোর কোন যতœ নেয়া হয় না বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল। এখন কী অবস্থায় আছে কে জানে! নোনাও ধরে যেতে পারে। পুরো মহেশাঙ্গনটাই এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যেটা আসলে এ রকম ছিল না কখনই। রামমালা গ্রন্থাগার এখন পরিত্যক্ত না প্রবেশ নিষিদ্ধ বোঝা মুশকিল। এর ভেতরে একটি লিটল ম্যাগ সাহিত্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা যেতেই পারে।
এটাও সত্য যে, বাঙালীর পাঠবিমুখতা ইতিহাসখ্যাত। আর এখন প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে আবস্থা আরও তথৈবচ। লিটল ম্যাগ এখনও বের হচ্ছে ঠিকই আগের মতো অগণিত নয়, প্রচার সংখ্যাও যেমন অপ্রতুল তেমনি চলে বলেও মনে হয় না। আগ্রহটা তেমন আর নেই তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যের জন্য। তারা যে কী পড়তে ভালবাসে বোঝা মুশকিল! লিটল ম্যাগ তথা ছোটকাগজের স্থান দখল করে চলেছে দ্রুতগতিতে ইন্টারনেট ওয়েবসাইট, অনলাইন ম্যাগাজিন, ব্লগ, ফেসবুক প্রভৃতি। সেগুলোতে যে মানসম্পন্ন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে তা বলা যাবে না। বহু বছরের ঐতিহ্য কাগুজে ঘ্রাণ সেখানে যেমন নেই তেমনি অঙ্গসজ্জার বৈচিত্র্যও অনুপস্থিত। আধুনিক মননশীল বইয়ের দোকান উদ্বোধন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মননশীল পাঠক যেন ক্রমহ্রাসমান। আজকাল সেবা প্রকাশনীর মুখরোচক হাল্কা আনন্দের বই খোঁজে কিশোর-কিশোরীরা কিন্তু সেগুলো কী সাহিত্য? জানি না। আমরাও কৈশোরে অনেক রহস্য গল্প বা গোয়েন্দা সিরিজের বই দেদার গিলেছি যেমন দস্যু শশধর, দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন, দস্যু বনহুর; দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্য গল্প, অদ্রীশ বর্ধন কিংবা ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্যপোন্যাস অথবা ভৌতিক ও ডাকাতির গল্প কম পড়িনি। সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা সিরিজও অনেক পড়েছি। কিন্তু পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, দ্বীজেন্দ্রলাল, শরৎ, ফাল্গুনী, বনফুল, তারাশঙ্কর, প্রভাত কুমার, জরাসন্ধ, দৃষ্টিপাত, যাযাবর, ইকবাল, কায়কোবাদ, ফররুখ, গোলাম মোস্তফা, মীর মোশারফ, বন্দে আলী, জসীমউদ্দিন প্রমুখের লেখাও পড়েছি। এগুলো এখন যদিওবা ক্লাসিক। এখনকার ছেলেমেয়েরা নামও জানে না। গ্রন্থাগার নেই দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে, থাকলেও প্রবেশ করতে দেয়া হয় না ছাত্রছাত্রীদের। মাদ্রাসার কথা আর বলে লাভ নেই। এক সময়কার অনুপম সংস্কৃতি দেয়ালপত্রিকা বা দেয়ালিকা কিংবা স্কুল ম্যাগাজিন এখন বিলুপ্ত। কিন্তু জাপানে দেখেছি দেয়াল পত্রিকা আজও গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছে।
পাঠবিমুখতা, সাহিত্যের প্রতি অনুৎসাহ এবং লেখালেখি চর্চার প্রতি অবজ্ঞার ধারা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে লিটল ম্যাগ কালচার লুপ্ত হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ আছে কী?
No comments:
Post a Comment