Tuesday, January 22, 2019

ফররুখ আহমদের কবিতা ডাহুক


 ডাহুক



রাত্রিভ’র ডাহুকের ডাক....
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির!
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
           ছলনার পাশা খেলা আজ প’ড়ে থাক,

                ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,

          কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে,
অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল।
অবিশ্রাম ঝ’রে ঝ’রে পড়ে
          শিশির পাখার ঘুম,
          গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল
          হ’য়ে আসে নিসাড় নিঝুম,
          নিভে যায় কামনা চেরাগ;
          অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক।

কোন্্ ডুবুরির
অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখীর
সামুদ্রিক অতলতা হ’য়ে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে,
ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।

          তুমি কি এখনো জেগে আছো?
          তুমি কি শুন্ছো পেতে কান?
          তুমি কি শুন্ছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান?

ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী!
চেতনার পথ ধরি চলিয়াছে তার স্বপ্ন-পরী,
মন্থর হাওয়ায়।
সাথী তন্দ্রাতুর।
রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়া প’ড়ে যায় ডাহুকের সুর।
শুধু সুর বাসে
বেতস বনের ফাঁকে চাঁদ ক্ষ’য়ে আসে
রাত্রির বিষাদ ভরা স্বপ্নাচ্ছন্ন সাঁতোয়া আকাশে।

মনে হয় তুমি শুধু অশরীরী সুর!
তবু জানি তুমি সুর নও,
তুমি শুধু সুরযন্ত্র। তুমি শুধু বও
আকাশ-জমানো ঘন অরণ্যের অন্তর্লীন ব্যথাতুর গভীর সিন্ধুর
অপরূপ সুর...
অফুরান সুরা...
          ম্লান হ’য়ে আসে নীল জোছনা বিধুর
                   ডাহুকের ডাকে!
হে পাখী! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
                   চিনিনি তোমাকে।
হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার।
কিন্তু যে অপূর্ব সুরা কাঁদাইছে রাত্রির কিনার
যার ব্যথা-তিক্ত রসে জ’মে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ,
ঘনায় তমালে, তালে রাত্রির বিরহ
সেই সুর পারি না চিনিতে।
          মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
          পাত্র ভরা সাকী।
          উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
          বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী।
হে অচেনা শারাবের ‘জাম’!
যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
সূর্যের অজানা দেশে
তারার ইশারা নিয়ে চলিয়াছ এক মনে ভেসে
সুগভীর সুরের পাখাতে,
          স্তব্ধ রাতে
          বেতস প্রান্তর ঘিরে
          তিমিরি সমুদ্র ছিঁড়ে
চাঁদের দুয়ারে;
যে সুরার তীব্র দাহে ভেসে চলো উত্তাল পাথারে,
প্রান্তরে তারার ঝড়ে
সেই সুরে ঝ’রে পড়ে
বিবর্ণ পালক,
নিমেষে রাঙায়ে যায় তোমার নিষ্প্রভ তনু বিদ্যুৎ ঝলক,
তীর তীব্র গতি নিয়ে ছুটে যায় পাশ দিয়ে উল্কার ইশারা,
মৃত অরণ্যের শিরে সমুদ্রের নীল ঝড় তুলে যায় সাড়া
উদ্দাম চঞ্চল;
তবু অচপল
গভীর সিন্ধুর
সুদুর্গম মূল হ’তে তোলো তুমি রাত্রি ভরা সুর।

ডাহুকের ডাক...
সকল বেদনা যেন সব অভিযোগ যেন
          হ’য়ে আসে নীরব নির্বাক।
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখী!
যাও ডাকি ডাকি
          অবাধ মুক্তির মত।
ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনি না তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।
এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃঙ্খলমুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবন মৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর।
তাই মুক্তি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
                   পূর্ণ করি বুক
                   রিক্ত করি বুক
অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না।
বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা:
ক্রমে তা’ও থেমে যায়;

প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়;
গাঢ়তর হ’ল অন্ধকার।
মুখোমুখি ব’সে আছি সব বেদনার
          ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে।
          রাত্রি ঝ’রে পড়ে

পাতায় শিশিরে...
জীবনের তীরে তীরে...
মরণের তীরে তীরে...
          বেদনা নির্বাক।
সে নিবির আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু
          তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক॥

ডাহুক সম্পর্কিত তথ্য:
ডাহুক | White breasted Waterhen | Amaurornis Phoenicurus
দেখতে অনেকটাই মুরগির মতো। শুধু আকারে খানিকটা ছোট। লেজটা অধিকাংশ সময় খাড়া থাকে। হাঁটার সময় লেজটাকে নাচিয়ে হাঁটে। জলাধারে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় বেশি দেখা যায়। খাবারের খোঁজে অনেক সময় মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। তবে ধরার আগেই ফুরুৎ করে দৌড়ে পালায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখিদের চেয়ে বাচ্চারা বেশি হুঁশিয়ারি। সহজে ধরা যায় না ওদের। বিশেষ করে জলাশয়ে বিচরণরত কালে বাচ্চাদের ধরা কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ। চতুর এ পাখি চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছেন আমাদের দেশে। এমন পরিচিতি লাভের আরেকটি কারণও আছে। সেটি হচ্চে এদের নিয়ে বেশ কিছু কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। যেমন : কবি জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছেন ‘ডাহুকী’ কবিতা। অপরদিকে কবি র্ফরুখ আহমেদ রচনা করেছেন ‘ডাহুক’ কবিতটি। বলা যায় বাংলা সাহিত্যে এ পাখির বেশ কদর রয়েছে।
আমি শৈশবেই এদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি নিজ গ্রামে। ঘরের লাগোয়া ঝোপের ভেতর থেকে ‘কোয়াক-কোয়াক’ সুরে ডেকে কান ঝালাপালা করে দিত আমাদের। অতিষ্ট হয়ে ওদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ে তাড়াতে চেষ্টা করতেন বড়রা। ওরা ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে ঝোপ-জঙ্গলে বসে আবার শুরু করে দিত ম্যারাথন ডাক। একটানা দীর্ঘক্ষণ ডাকতে পারে এ পাখি। রাত-বিরাতেও ডাকে। বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর বিরতিহীন ডাকতে থাকে। এ নিয়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের ভেতরে কিছু কৌতূহল রয়েছে। নানা মানুষ নানা মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বলেন, ‘ডাকতে ডাকতে ওদের গলা থেকে রক্তের ফোঁটা বের হয়। আর সে রক্তের ফোঁটা ওদের ডিমের ওপর পড়লেই তবে ডিম ফোটে। আবার কেউ বলেন, ‘মানুষকে ওরা বিপদ সংকেত জানায়’। আসলে ওসবের কিছুই নয়। শুধু ওদের প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে প্রেমিক পাখিটি এমন আর্তনাদ করে প্রিয়াকে মজাতে চেষ্টা করে। এরা ভালো পোষ মানে। গ্রামের শিকারিরা পোষাপাখি দিয়ে এ প্রজাতির বুনোপাখি শিকার করে। এদের মাংসে কিছুটা মুরগির মাংসের স্বাদ পাওয়া যায় বিধায় শিকারিরা এ পাখি শিকারে বেশ সচেষ্ট। অধিকধৃত হওয়ার পরও এরা আমাদের দেশে মোটামুটি সুলভ। দেখা মেলে যত্রতত্র।
এ পাখির বাংলা নাম: ‘ডাহুক’, ইংরেজি নাম: ‘হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন’, (White-breasted Waterhen), বৈজ্ঞানিক নাম:‘আমাররনিস ফোনিকুরাস’,(Amaurornis Phoenicurus), গোত্রের নাম: ‘রাল্লাদি’।
লম্বায় ৩২-৩৩ সেন্টিমিটার। শক্ত মজবুত গড়নের ঠোঁটের বর্ণ সবুজ। ঠোঁটের গোড়া লাল। কপাল, গলা, বুক সাদা। লেজের তলা সিঁদুরে-বাদামি। শরীরের বাদবাকি পালক ছাই-কালো রঙের। পা লম্বা লিকলিকে। পায়ের আঙ্গুলের বর্ণ সবুজ। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম।
ডাহুক পাখির প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, ধান ইত্যাদি। পোষা ডাহুক চাল, ভাত খায়। প্রজনন সময় আষাঢ় থেকে শ্রাবণ। বাসা বাঁধে জলার ধারে ঝোপ-জঙ্গলে কিংবা জলদামের ওপর অথবা বাঁশঝাড়ে। ডিম পাড়ে ৫-৭টি। স্ত্রী-পুরুষ মিলে ডিম তা দেয়। ডিম ফুটতে সময় লাগে ১৮-২০ দিন।
লেখক: আলম শাইন। কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক, বন্যপ্রাণী বিশারদ ও পরিবেশবিদ। 

সূত্র: দৈনিক মানবকণ্ঠ, 28/01/2013
..........................................................................

ফররুখ আহমদের ডাহুক 

-ডক্টর সদরুদ্দিন আহমেদ


যে কোন কবিতা পড়তে গেলে বা মূল্যায়ন করতে গেলে তার form বা সেটা কি ধরনের কবিতা তা জানা দরকার কারণ form ও content কবিতার ধরণ ও বিষয়বস্তু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ‘‘ডাহুক ’’ একটি Ode. এই জাতীয় কবিতা কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়। কোন ব্যক্তি বা প্রাণী বা abstract quality- কে সম্মোধন করা হয়। এটি লিরিকধর্মী কবিতা, তবে নিখাদ লিরিক নয়, এর মধ্যে আবেগ ও চিন্তা-ভাবনার (reflection) সমাবেশ থাকে। ইংরেজী সাহিত্যে পাখীর উপর বেশ কয়েকটি ode আছে। এদের মধ্যে কীটসের Ode to a Nightingale ও শেলীর To a Skylark উল্লেখযোগ্য। এ দু'টি কবিতার সঙ্গে ‘‘ডাহুক’’ এর কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আছে। ‘‘ডাহুক’’ কবিতায় speaker বা বক্তা ডাহুককে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছেন, ডাহুকের ডাক নিয়ে তার আবেগ, চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করছেন। সময়টা রাত্রিবেলা। ডাহুক ডেকে চলেছে, ‘রাত্রিভর ডাহুকের ডাক' আর বক্তা ‘দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে' আছেন। তার পাড়ার সবাই ঘুমে অচেতন। স্তব্ধদীঘি অতল সুপ্তির-এই চিত্রকল্প তাদের ঘুমের গভীরতার প্রতি ইঙ্গিত করে। তাদের প্রতি বক্তার দৃষ্টিভঙ্গী শ্লেষাত্মকঃ ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি....... ছলনার পাশা খেলা ও দিনের মৌমাছি এ দুটি চিত্রকল্পের মধ্যে সারা দিন তারা কীভাবে কাটায় তা নিয়ে ব্যঙ্গ আছে। বক্তা নিজেকে আলাদা করে দেখছেন। মনোযোগ দিয়ে ডাহুকের ডাক শোনার জন্য তিনি নিজেকে তাগিদ দিচ্ছেন, কান পেতে শোন আজ ডাহুকের ডাক। কীট্সের Ode to a Nightingale কবিতায় প্রায় অনুরূপ একটি দৃশ্য পাই। নাইটিঙ্গেল এক ছায়া-ঢাকা বনানীতে বসে কণ্ঠভরে আনন্দের গান গাচ্ছে , তার বক্তা সে গান শুনে পুলকিত বোধ করছেন। তার পুলক এত গভীর যে তার মনে হচ্ছে তিনি বিষপান করে বিষ্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন। তাবে উভয় দৃশ্যের মধ্যে তফাৎ এই যে ‘‘ডাহুক’’-এর বক্তা কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন না। তিনি শুধু নিবিষ্ট মনে ডাহুকের ডাক শুনছেন: ডাহুকের অবস্থান সম্বন্ধেও কিছু বলেন নি। ডাহুকের ডাক শুনতে শুনতে বক্তা আকাশের দিকে তাকালেন। সেখানে দেখলেন ঃ তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে, অশ্রান্ত ডুবুরী যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে স্বপ্নের প্রবাল। অবিশ্রাম ঝরে ঝরে পড়ে শিশির পাখার ঘুম, গুলে বকৌলির নীল আকাশ মহল হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম নিভে যায় কামনা-চেরাগ; অবিশ্রান্ত ওঠে শুধু ডাহুকের ডাক। কোন্ ডুবুরির অশরীরী যেন কোন্ প্রচ্ছন্ন পাখীর সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক উঠে আসে। ঝিমায় তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে। চাঁদের সঙ্গে ডাহুকের ডাকের সম্পর্ক বা প্রাসঙ্গিকতা কি? সাধারণতঃ চাঁদ রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। কীট্সের নাইটিঙ্গেল কবিতায় দেখি চাঁদ-রাণী ( Queen-Moon) সিংহাসনে বসে আছেন, তারার পরীরা তাকে ঘিরে রেখেছে। চাঁদ ও তারার এই চিত্রকল্প নাইটিঙ্গেলের জগতকে মোহনীয় করেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু ‘‘ডাহুক’’-এ চাঁদের চিত্রকল্প অনেক বেশি অর্থবহ, অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। চাঁদ ও ডাহুক উভয়ই প্রচ্ছন্ন; চাঁদ মেঘের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন, ডাহুককে প্রচ্ছন্ন পাখী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উভয়ই অশ্রান্ত, চাঁদ অশ্রান্তভাবে ভেসে চলেছে, ডাহুক অবিশ্রামভাবে ডেকে চলেছে। তাই চিত্রকল্প দু'টি একীভূত হয়েছে। তারা একটি কিছুর প্রতীক, কিন্তু কিসের প্রতীক সেটা কবিতার এই পর্যায়ে স্পষ্ট নয়। উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত দু'টি স্তবকে একটা স্বপ্নাচ্ছন্ন পরিবেশের চিত্রকল্প আছে। ঘুম ঝরে ঝরে পড়ছে, নীল আকাশ নিসাড়, নিঝুম হয়ে আসছে, কামনা-চেরাগ নিভে যাচ্ছে, তারার দীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে ঝিমুচ্ছে। এই পরিবেশে কারুর জেগে থাকার কথা নয়। তাই বক্তা নিজেকে সচকিত করে জিজ্ঞাসা করছেন? তুমি কি এখনো জেগে আছো? তুমি কি শুনছো পেতে কান? তুমি কি শুনছো সেই নভঃগামী শব্দের উজান? শেলীর স্কাইলার্ক অস্তগামী সূর্যের সোনালী আলোয় দ্রুত বেগে উর্দ্ধে উঠে দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে গান গায়। সে গানে ধরণী প্লাবিত হয়। কিন্তু ডাহুক খালে-বিলে থেকে ডাকে এবং তার ডাক নভঃগামী, উজানে ধাবিত হয়,অর্থাৎ তার ডাক পৃথিবীর মানুষের জন্য নয়, তার ডাক পৃথিবীকে অতিক্রম করে অন্য এক জগৎ বা সত্তার উদ্দেশ্য নিবেদিত। তাছাড়া ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী। চেতনার পথ ধরে তার স্বপ্নপরী চলছে মন্থর হাওয়ায়। স্পষ্টতঃ গন্তব্য বহু দূরে, কিন্ত একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে সে চলছে। তবে সে লক্ষ্য এখনো অস্পষ্ট। কবিতাটির আরম্ভ থেকে এ পর্যন্ত ঘুম ও জাগ্রত অবস্থা-এ দু'য়ের মধ্যে একটা tension.একটা নাটকীয় সংঘাত লক্ষ্য করা যায়। দিনের কর্মব্যস্ততা, রাত্রির স্বপ্নাচ্ছন্ন পরিবেশ স্বাভাবিকভাবে ঘুমের উদ্রেক করে এবং এই ঘুম মানুষের জগৎকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু ডাহুক এই মানবিক দুর্বলতার উর্দ্ধে। তাকে মানুষের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে। বক্তার অবস্থান এই দুই বিপরীতের মাঝখানে বলে মনে হয়। ঘুম তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে নি। ঘুমের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী নেতিবাচক। তিনি জেগে ডাহুকের ডাক শুনছেন। অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে এই ডাকের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী ইতিবাচক, কিন্তু কোন কারণে তিনি সেই ডাকের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারছেন না। এ পর্যন্ত ডাহুক সম্বন্ধে আমরা যে ধারণা পাই তা হলো ঃ সে একটি প্রচ্ছন্ন পাখী সে সারা রাত ডেকে চলছে এবং তার ডাক সামুদ্রিক অতলতা থেকে উর্দ্ধপানে উঠে যাচ্ছে। এরপর কবিতাটি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। কাঠামোর দিক দিয়ে এই অংশটি কবিতার দ্বিতীয় স্তর। এই অংশে ডাহুকের ডাক বা সুর সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন চিত্রকল্পের মাধ্যমে। বক্তা ডাহুকের সুরকে ‘‘রাত্রির পেয়ালা পুরে উপচিয়ে’’ পড়া সুর বলেছেন। এর সঙ্গে শেলীর স্কাইলার্ক কবিতার নিম্মোক্ত লাইনগুলোর তুলনা করা যেতে পারে। Bird thou never rest That from heaven or neat it Pourest thy full heart In profuse strains of unpremeditated art উভয় পাখীর সুর প্রাচুর্যে ভরা, তবে দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্প (visual image) হিসেবে ফররুখের পেয়ালা উপচিয়ে পড়া সুর অনেক বেশি আবেদন সৃষ্টি করে। যা হোক, ইতোমধ্যে রাত্রি গড়িয়ে চলেছে। বেতস বনের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ ক্ষয়ে আসছে। চাঁদের চিত্রকল্প দ্বিতীয় বার ব্যবহৃত হলো। এই চিত্রকল্পের সঙ্গে কবিতার শুরুতে মেঘের অন্তরালে ডুবুরীর মত ডুব দিযে ভেসে চলা চাঁদের চিত্রকল্পের অনেক তফাৎ। ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ কি রাত্রি অবসানের ইঙ্গিত করছে? বক্তা আবার সুরের প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। তিনি যেটাকে সুর বলে মনে করেছিলেন সেটা আসলে সুর নয়, সুরের যন্ত্র। ডাহুক শুধুএই সুর, এই অপরূপ সুর বহন করছে। সে একটা মাধ্যম মাত্র। পরক্ষণে চিত্রকল্প পরিবর্তিত হলো। পাখী সুরযন্ত্র নয়, সুরাপাত্র, ‘সুরাবাহি পাত্র ভরা সাকী'। এরপর পাখীর সঙ্গে তার সুরের পার্থক্যের কথা বলা হচ্ছে। পাখী প্রচ্ছন্ন, কিন্তু তিনি ছবিতে তার ‘বর্ণ সুকুমার' দেখেছেন। এ ভাবে পাখীটিকে চিনলেও তার সুরকে চিনতে পারছেন না, যে সুরার ব্যথা-তিক্ত রসে বনপ্রান্তে, তালে-তমালে দুঃসহ বেদনা সৃষ্টি বেদনা সৃষ্টি করছে। কেন এই বেদনা, বিরহ-আপাততঃ তার কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তী স্তবক, এটি কবিতার দীর্ঘতম স্তবক, পড়তে গিয়ে পাঠককে হোঁচট খেতে হয়। এই স্তবকে এমন কিছু চিত্রকল্প আছে যা ইতোপূর্বে ব্যবহৃত চিত্রকল্পের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে। আমরা একটু আগে দেখেটি যে ডাহুককে সুরযন্ত্র ও সরাপাত্র বলে চিহ্নেত করা হয়েছে। সে সুর বা সুরা বহন করে মাত্র। কিন্তু এই স্ববকে তাকে ‘সুরার পিপাসায় উন্মখ' করে উল্লেখ করা হয়েছে। সে পিপাসায় অবিশ্রান্তভাবে সূর্যের অজানা দেশের তারার ইশারা নিয়ে ভেসে চলেছে সুগভীর সুরের পাখাতে। সুরার তীব্র দাহে সে প্রান্তরে, সাগরে, আকাশে, এমন কি মহাশূন্যে উদ্দাম গতিতে ছুটে চলেছে। তার পাশ দিয়ে তীব্র বেগে উল্কাও ছুটে যাচ্ছে এবং তার নি্রভ তনু ঝলসে উঠছে। স্তবকটির ছন্দে তার উদ্দাম গতির প্রকাশ আছে। ভাবের সঙ্গে সংগতি রেখে ছন্দে গতিশীলতা আনা হয়েছে। কিন্তু এখানে বক্তব্যের অসঙ্গতি, পরস্পর-বিরোধী চিত্রকল্পের প্রয়োগ কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? এ প্রবন্ধের উপসংহার এ প্রশ্ন আলোচনা করা হবে। ডাহুক সম্বন্ধে বক্তার বিভিন্ন আবেগ বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের পর কবিতার শেষ অংশে ডাহুকের আসল স্বরূপ এবং মানুষের সঙ্গে তার পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। ডাহুক মুক্ত পক্ষ,& আমরা শৃক্মখলিত; ডাহুকের ডাক অবাধ মুক্তির মত, আমরা সে ডাক শুনে নিজেদের বিষাক্ত ছোবলে আহত, জর্জরিত-ডাহুক শৃক্মখলমুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবন-মৃত্যুর পরিপূর্ণ সুর বহন করে চলে, আমরা ম্লান কদর্যের দলভুক্ত। ডাহুক নিভৃতে পূর্ণ করি বুক রিক্ত করি বুক' ডাকতে পারে, আমরা পারি না। মানুষ ও ডাহুকের এই পার্থক্যের রেশ ধরে একটি বিষদময় পরিবেশের ইঙ্গিত দিয়ে কবিতাটি শেষ হয়েছে। বাতাস পড়ে গেছে, চাঁদ ডুবে গেছে, অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে এসেছে। চারদিকে নির্বাক বেদনার পরিবেশে বক্তা নীরবে বসে আছেন, আর নিবিড় অন্ধকারে দূর বনে তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক শোনা যাচ্ছে। আমরা ডাহুককে Ode জাতীয় কবিতা বলেছি। এতে speaker বা বক্তা ডাহুক সম্বন্ধে কথা বলছেন। কিন্তু ‘‘সাত সাগরের মাঝি’’ কবিতায় বক্তার সঙ্গে ‘‘ডাহুক’’ এর বক্তার একটা তফাৎ আছে। সেখানে বক্তা একজন চরিত্র হিসেবে প্রতিভাপ হয়েছেন, কিন্তু ‘‘ডাহুক’’ এর বক্তাকে চরিত্র বলা যায় না, তিনি একটি voice বা কণ্ঠস্বর। এ কণ্ঠস্বর ডাহুককে কেন্দ্র করে একটি theme বা বিষয়বস্তুর উপর meditate বা ধ্যান করছেন। এই theme বা বিষয়বস্তু কি? সেটা বলার আগে ডাহুক সম্বন্ধে কি ধারণা পাওয়া যায় দেখা যাক। পাখি হিসেবে ডাহুকের কোন বর্ণনা কবিতায় নেই, যেমন নাইটিঙ্গেল ও স্কাইলার্কের কোন বর্ণনা আমরা পাই না। আসলে রক্ত-মাংসের পাখির চেয়ে তাদের গান বা ডাক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ডাহুকের ডাক সম্বন্ধে যে সব চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে এবং যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ডাহুক একটি Symbol বা প্রতীক। এই প্রতীক আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? ডাহুক সম্বন্ধে উপস্থাপিত তথ্য এই : ডাহুক নিঃসঙ্গ, নিভৃত, প্রচ্ছন্ন। সে অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে। অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে। সে ডাক বিষাদময় ও নভঃগামী, তার সঙ্গে চাঁদের একটা সম্পর্কের কথা কবিতার প্রথম দিকে উল্লেখ করা হয়েছে। উভয়ই প্রচ্ছন্ন, অশ্রান্ত এবং ডুবুরীর মত ডুব দিয়ে মূল্যবান কিছু তুলে আনছে। কিন্তু পরে দেখতে পাই যে চাঁদ ক্ষয়ে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে আসছে, কিন্তু ডাহুকের ডাক অবিশ্রান্তভাবে উঠে আসছে। প্রকৃতির সঙ্গে একটি সম্পর্কের ইঙ্গিত প্রথম দিকে আছে। ডাহুকের ডাক অরণ্যে, তালে, তমালে সমুদ্রে বেজে উঠছে, কিন্তু শেষের দিকে বলা হয়েছে বেতস বনের তারে তারে বাতাস মাঝে মাঝে বেজে উঠে শেষ পর্যন্ত থেমে গেছে। মানুষের সঙ্গে ডাহুকের পার্থক্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার ডাক মানুষের উদ্দেশ্যে নয়, কারণ তার ডাক নভঃগামী। বক্তা তার ডাকে সাড়া দিতে পারছেন না কারণ তার মানবিক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা আছে এবং সম্ভবতঃ এ কারণেই তিনি বিষাদময়, বেদনাক্লিষ্ট। উপরোক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ কথা অনুমান করা কি অযৌক্তিক হবে যে ডাহুক জড় জীবনের শৃংখল ও কদর্যমুক্ত আত্মার প্রতীক? এই আত্মা পরমাত্মাকে ডাকছে, জিকির করছে ক্রমাগত। এই ব্যাখ্যার অন্যূতম ভিত্তি এই যে তার ডাক গভীরতম কন্দর থেকে, সামুদ্রিক অতলতা থেকে, উঠে যাচ্ছে ঊর্ধ্বপানে। প্রকৃতিকে অতিক্রম করে, মানুষকে উপেক্ষা করে সুরের পিপাসায় উন্মুখ এই শরাবের পেয়ালা মহাশূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে কি পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য? এই জন্য কি তার ডাক তৃষাদীর্ণ তার ডাক অবিশ্রান্ত ও বিষাদময় কি এইজন্য যে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সাধনার শেষ নেই এবং মিলন সহজ নয়। এর বেশি আর বলা সম্ভব নয় কারণ কোন প্রতীক সম্প্রসারিত করলে তার কোন মূল্য থাকে না। W.M. Urban-এর ভাষায় : If we expand the symbol. We lose the sence or value of the symbol as symbol. (language as Reality) quouted by Cleanth Brooks in the Wellwrought Urn. কবিতা হিসেবে অনেকে ‘‘ডাহুক’’-এর উচ্ছবসিত প্রশংসা করলেও বিরূপ সমালোচনাও আছে। একজন সমালোচক লিখেছেন : The text is full of contradiction as well as of shift in tone. attitude and viewpoint. A smooth cronological progression, which can be attributed to a spiritual journey, is absent in the text, which only presents some contradictions and isunified feelings and images of a distracted mind of a frustrated man. (Ali Azgor : 'Farrukh's Dahuk', Observer Magazine, Decemebr 10, 1999). এখানে সমালোচক কবিতাটির যে দিকগুলো কবির মানসিক বিভ্রান্তির প্রতিফলন বলে উল্লেখ করেছেন তার অনেকগুলো আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য উদাহরণস্বরূপ, টি,এস, এলিয়টের সুবিখ্যাত The Waste Land কবিতায় tone ও point of view বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। বক্তব্যের ধরাবাহিকতাও নেই। পরস্পর-বিরোধী আবেগ ও চিত্রকল্প পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কবির বিরুদ্ধে মানসিক বিভ্রান্তির অভিযোগ কেউ তোলেননি, বরং এসব টেকনিক প্রশংসিত হয়েছে। অসংগতি বা পরস্পর-বিরোধী ভাব বা আবেগ বা চিত্রকল্প সম্বন্ধে বলা যায় যে সেগুলোর একটা তাৎপর্য আছে। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত সমালোচক Cleanth Brooks লিখেছেন যে, সব ভাল কবিতার মৌলিক structure বা কাঠামো হলো "a structure of 'sestures' of attitudes" এসবের উদ্দেশ্য হলো 'to modify, qualify and develop the total attitude'. তিনি আরও বলেন : "The characteristic unity of a poem (even of those poems which may accidentally possess logical unity as well as this poetic unity) lies in the unificatiion of attitudes into a hierarchy subordinated to a total and governing attitudes (The Wellwrought Urn) p. 168. আমরা দেখেছি কবি ডাহুকের প্রতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছেন। সে কখনো বা সুর, কখনো সুরযন্ত্র, কখনো শরাবের জাম, আবার কখনো সুরের পিপাসায় উন্মুখ। ডাহুক খালে-বিলে, ঝোঁপ-ঝাড়ে বাস করা পাখি কিন্তু এক স্তবকে সে শরাবের পিপাসায় উন্মুখ হয়ে চাঁদ, তারা পর্যন্ত তীব্র দাহে ভেসে চলেছে। কিন্তু পরক্ষণে বলা হচ্ছে : তবু অচপল গভীর সিন্ধুর সুদুর্গম মূল হতে তোলো তুমি রাত্রিভরা সুর। আসলে এই চিত্রকল্পটি ডাহুকের প্রতি কবির মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছে এবং এটি কবিতায় বার বার ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি সাময়িকভাবে তার আবেগ প্রকাশ করছে মাত্র কিন্তু সেগুলো তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে Susanne Langer-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য : .. though the material of poetry is verbal. its import is not the literal assertions are made in the words but the way the assertions are made, and this involves the sound, the tempo, the aura of associations of the words, the long or short sequences of ideas, the wealth or poverty of transient imagery that contains them, the sudden arrest of fantasy by pure fact or of familiar fact by sudden fantasy, the suspense of literal meaning by a sustained ambiguity resolved in a long-awaited key-word and the unifying, all embracing artifice of rhythm (Philosophy in a New Key) quoted by Cleanth Brooks: The well Wrought Urn, P. 166.) এখানে অনেকগুলোর মধ্যে চারটি Point গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত বক্তব্যকে আক্ষরিকভাবে না দেখে কীভাবে তা বলা হচ্ছে সেটা বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয় : পরিচিত ঘটনা (familiar fact) স্তব্ধ রেখে অপরিচিত জগতে বিচরণ করতে পারে বা অপরিচিত জগৎ থেকে বাস্তব জগতে ফিরে আসতে পারে। তৃতীয়ত : একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা চিত্রকল্প বিপরীতমুখী চিত্রকল্পের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। চতুর্থত : ছন্দের ব্যবহার সব কিছুকে একীভূত করতে পারে। এই বক্তব্যের আলোকে কবিতাটিকে বিবেচনা করলে যেসব আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর কোন গুরুত্ব থাকে না। মাটির পৃথিবীতে অবস্থান করে ডাহুকের মহাশূন্যে ছুটে চলা একটা Sudden fantasy, কিন্তু পরক্ষণে তাকে নিজের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে যখন আমরা পড়ি : তবু অচপল গভীর সিন্ধুর সুদুর্গম মূল হতে তোলো তুমি রাত্রি ভরা সুর। ‘‘ডাহুক’’ একটি দীর্ঘ কবিতা কিন্তু আমরা দেখেছি এর একটা structure বা কাঠামো আছে যা তিনটি স্তরে বিভক্ত। স্তরগুলোর মধ্যে যৌক্তিক সম্পর্ক না থাকলেও emotional coherence আছে এবং সব উপমা, রূপক এবং চিত্রকল্প শেষ পর্যন্ত সমন্বিত রূপ লাভ করেছে। বিষয়বস্তু, তার উপস্থাপনা, প্রয়োগ, চিত্রকল্প ও প্রতীকের নিপুণ ব্যবহার ইত্যাদি বিবেচনা করলে ‘‘ডাহুক’’ নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।

তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা - শামসুর রাহমান


Monday, January 21, 2019

খোকার সাধ - কাজী নজরুল ইসলাম

আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।

সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,

'হয়নি সকাল, ঘুমো এখন'- মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, 'আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো!
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!'
ঊষা দিদির ওঠার আগে উঠব পাহাড় চূড়ে,
দেখব নিচে ঘুমায় শহর শীতের কাঁথা মুড়ে,
ঘুমায় সাগর বালুচরে নদীর মোহনায়,
বলব আমি 'ভোর হল যে, সাগর ছুটে আয়!
ঝর্ণা মাসি বলবে হাসি', 'খোকন এলি নাকি?'
বলব আমি নইকো খোকন, ঘুম-জাগানো পাখি!'
ফুলের বনে ফুল ফোটাব, অন্ধকারে আলো,
সূয্যিমামা বলবে উঠে, 'খোকন, ছিলে ভাল?'
বলব 'মামা, কথা কওয়ার নাইকো সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙ ঘুমের দ্বার।'
রবির আগে চলব আমি ঘুম-ভাঙা গান গেয়ে,
জাগবে সাগর, পাহাড় নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে!

Please see this video:

Thursday, January 17, 2019

সবার আমি ছাত্র - সুনির্মল বসু

সবার আমি ছাত্র

- সুনির্মল বসু

আকাশ আমায় শিক্ষা দিল 
উদার হতে ভাই রে, 
কর্মী হবার মন্ত্র আমি 
বায়ুর কাছে পাই রে। 
পাহাড় শিখায় তাহার সমান- 
হই যেন ভাই মৌন-মহান, 
খোলা মাঠের উপদেশে- 
দিল-খোলা হই তাই রে। 
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয় 
আপন তেজে জ্বলতে, 
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে, 
মধুর কথা বলতে। 
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর- 
অন্তর হোক রত্ন-আকর; 
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম 
আপন বেগে চলতে। 
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা 
পেলাম আমি শিক্ষা, 
আপন কাজে কঠোর হতে 
পাষান দিল দীক্ষা। 
ঝরনা তাহার সহজ গানে, 
গান জাগাল আমার প্রাণে; 
শ্যাম বনানী সরসতা 
আমায় দিল ভিক্ষা। 
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, 
সবার আমি ছাত্র, 
নানান ভাবে নতুন জিনিস 
শিখছি দিবারাত্র। 
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়, 
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায় 
শিখছি সে সব কৌতূহলে, 
নেই দ্বিধা লেশমাত্র। 

সেক্রেটারিয়েট -আবদুল কাদির খান


সেক্রেটারিয়েট
-আবদুল কাদির খান


এখন দশটা দশ মিনিট
মানুষের কোলাহলে ভরপুর সেক্রেটারিয়েট
গেট পার হয়ে ঢুকেছি
যেন ‘পুলছেরাত’ পার হয়েছি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললুম।
এক, দুই, তিন চার, পাঁচ
লিফটম্যান ব্যাস
থামাও ভাই নামবো।
এটা কোন দপ্তর?
রাজস্ব, বাণিজ্য না স্বাস্থ্য ?
লেখা আছে তীর চিহ্নে
পেয়ে যাবেন অবশ্য
ঢুকুন।
সালাম ঠুকুন।
নিস্তব্ধতা দশ মিনিট
কেরানী সাহেব
চশমার ফাঁকে কৃপা করলেন,
চোখ তুললেন
কী চাই?
প্রশ্নবাণ ছুড়লেন।
দেখুন আমার অমুক ফাইলটা ...................।
খু-উ-ব ব্যস্ত
একটু পরে আসুন।
এক প্যাকেট ক্যাপস্টান বা ডানহিল
আলবৎ ফাইল ঠিক।
সেকশন অফিসারের রুমে ?
ঢুকে পরুন
মিষ্টি কথায় প্রশ্নের উত্তর
বাসায় দেখা করুন।
কাজ আছে?
পরিচালকের কাছে?
উপ, যুগ্ন বা একান্ত সচিবের কাছে?
কিছু ছাড়ুন পিয়নের হাতে
কাজ হাসিল হবে তাতে
মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে
কিছু বলার আছে?
একান্ত সচিবকে ধরে এপয়েন্টমেন্ট করতে হয়
দুই হপ্তা বা তারও বেশী 
সময় লাগবে নিশ্চয়ই ।
আপনার অবশ্য জরুরী কাজ আছে
মন্ত্র সাহেব পাঠালেন সচিবের কাছে
ফাইলটা তৈরী করে পাঠান
সচিব মহোদয় বড্ড ব্যস্ত
হাতে তার রাজ্যের কাজ।
কিছিিদন পর শুরু হল ফাইল যাত্রা
সচিব থেকে যুগ্ন-সচিব
যুগ্ন থেকে উপসচিব
উপ থেকে পরিচালক
আরো নিচে আরো নিচে
দপ্তর তেকে দপ্তরে
ঘুরে ফিরে ধীরে ধীরে
অভিজ্ঞতা সঞ্চারে
লেখার বাহুল্য নিয়ে
‘এল ডি’ -তে এসে থামলো।
তারপর পূণঃ যাত্রা
‘এল ডি’র মতামত নিয়ে 
নাচের মহড়া দিয়ে
মতামত আরো নিয়ে
মন্ত্রী সাহেবের কাছে থামলো।
তিনি নমনীয় নির্দেশে
লিখলেন- “ঠিক আছে কিংবা নাই”।
এসব দৃশ্যের মাঝে
মনে হয় একী প্রেতপুরী?
নাকি লক্ষিন্দরের নিচ্ছিদ্র
লৌহ বাসর?
মানুষের ভাগ্য বিধাতারা বসে
ভাগ্য রচে জনে জনে
আঁক কষে, অংক করে
মিলিয়ন বিলিয়নে
অথচ মানুষের ভাগ্যে জুটে শূণ্য হাহাকার
তাই আজ শোষিতের শ্লোগান
নিপাত যাক আমলাতন্ত্র, ধনতন্ত্র, সবতন্ত্র
গাও সবে মহামুক্তির গান।

নবাব নবাবী করে । সুমন চট্টোপাধ্যায় । আবৃত্তি: শিমুল মুস্তাফা

Wednesday, January 16, 2019

নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় - হেলাল হাফিজ



জনপ্রিয় দেশাত্ববোধক গান: এই পদ্মা এই মেঘনা।


কবি সায়ীদ আবু বকর এর ‘কাগজ কুসুম’ নিয়ে কিছু কথা

আবদুল হালীম খাঁ : কবি সায়ীদ আবু বকর এর ‘কাগজ কুসুম’ কাব্য পাঠ করে আমার কবি আবদুস সাত্তার অনূদিত জীবরান খলীল জীবরানের গদ্য রীতিতে লেখা কাব্য ‘রামালু ওয়া জাবেদা’ (বালি ও ফেনা)-এর কথা মনে পড়ছে। বালি ও ফেনা এবং কাগজ কুসুম এর বিষয় অবশ্য ভিন্ন। ‘বালি ও ফেনা’ কবিতার হেডিংহীন একটানা শেষ পর্যন্ত গদ্য রীতিতে লেখা। কাগজ কুসুমের প্রতিটি কবিতার নাম রয়েছে এবং একটানা গদ্যে লেখা।
দু’টি কাব্য সামনে রাখলে মনে হয় দু’কবির চিন্তাভাবনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে এবং সে মিলটা খুব কাছাকাছি। মানব হৃদয় দর্পণে সমকালীন সমাজ ও পৃথিবীর যেমন ছায়া পড়ে সেই ছায়ার মতো। জীবরান লিখেছেন:
আমি চিরদিন এই সমুদ্রের তীরে ভ্রমণ করবো
এই বালি এবং ফেনার মধ্যে।
উন্মত্ত জোয়ার এসে আমার পায়ের দাগ মুছে ফেলবে
দুরন্ত ঝড়ো হাওয়া নিশ্চিহ্ন করে দেবে সকল ফেনা,
কিন্তু এই সমুদ্র এবং সমুদ্রের তীর
অনন্ত কালের ঘরে বর্তমান থাকবে।
     (বালি ও ফেনা-পৃ:-১)
কবি সায়ীদ আবু বকর লিখেছেন:
এই নীল সমুদ্র শয্যায়
শুয়ে আছে সহ¯্র মানুষ। শুয়ে আছে নাকি
ডলফিন মৎস্য কন্যাদের সাথে নেচেনেচে গান গায়
সোনালী রূপালি জলের গহিনে, যখন ক্রীড়ায় মত্ত সব বসন্তের পাখি
ঝাঁক বেঁধে চঞ্চল চঞ্চুতে নিয়ে যায় তুলে ধবধবে সমুদ্রে ফেনা?
(সমুদ্রের গান,-পৃ. ৬২)

উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে সমগোত্রীয় আরো কয়টি কবিতার নাম উল্লেখ করা যায়। যেমন- দিব্য দর্শন, ভয়, নাটকের মতো ইত্যাদি। বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে কিন্তু বিষয় উপস্থাপন ও বর্ণনা ভঙ্গিটা উভয়ের কাছাকাছি।
জীবরান মূলত: দার্শনিক কবি। তাঁর দর্শন তত্ত্বের মূল বক্তব্য আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে জীবনবোধের উন্মেষ সৃষ্টি। জীবন চৈতন্যের সমস্ত উপকরণ আল্লাহ্র সৃষ্টি রহস্যে ব্যাপ্ত। সৃষ্টি রহস্য গভীরভাবে পাঠ করে আল্লাহ্র অস্তিত্বে নিজকে মিশিয়ে দেয়াটাই জীবনের চরম সার্থকতা ও পরম তৃপ্তি। সেই তৃপ্তির মধ্যে নিহিত আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ। ¯্রষ্টা সৃষ্টির এই সমন্বয় সাধনÑ এই চির সত্যই জীবরান দর্শনের মূল বিষয়বস্তু।
কোনো কবিই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রথমই একটা সিদ্ধান্ত বা জীবনদর্শন দিতে পারেন না। তাকে দর্শন শ্রবণ ও অনুভবের মাধ্যমে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। জীবরানের যে জীবন দর্শনের কথা বলছি এটা তার সারাজীবন পুড়িয়ে ক্রমে ক্রমে অর্জন।
সায়ীদ আবু বকর প্রবীণ কবি নন, দু’হাতে লিখছেন, নতুন নতুন স্বপ্ন তাঁর চোখে। জগৎ ও জীবনের অনেক পৃষ্ঠা পাঠ করা এখনো তার বাকী। তার সামনের অতি বাস্তব চিত্র- যা দৃশ্যমান, যেমন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমকালীন বিশ্ব নিয়ে তার কবিতার বিষয় উপাত্ত। তবে তার দৃষ্টি ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অন্যদের মতো নয়Ñ অনেকটা পৃথক। প্রতিনিয়তই নতুনের দিকে তাঁর যাত্রা। একই গাছে কোনো পাখি দু’বার বাসা বাঁধে না। একই বাসায় পাখিরা দু’বার ডিম পাড়ে না। প্রতিবারই নতুন বাসা নতুন আবহে ভ্রমণ করতে চায় উড়ে উড়ে। মহান ¯্রষ্টার নতুন নতুন সৃষ্টি দেখার আকাক্সক্ষা যে পাখিদের সমাজবদ্ধ মানুষের অনেকেরই তা নেই। কবিরা সমাজবদ্ধ হলেও তাদের মন একই ঘাটের পানিতে তৃপ্ত নয়, তারা সৃষ্টি কর্মে ও চিন্তায় ধ্যানে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ছুটে চলেন। যেহেতু জীবন অনন্তের যাত্রী।
কবি সায়ীদ আবু বকর ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত আটটি কাব্যগ্রন্থে যেন একদিগন্ত থেকে নতুন আরেক দিগন্তে ছুটে চলেছেন। অবিরাম তাঁর লেখার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন। একদিক থেকে আরেক দিকে ভ্রমণ। শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বর্তমানে তিনি এসে থিতু হয়েছেন কাগজ কুসুমে। কী আছে তাঁর এ কাব্যে?
সায়ীদ আবু বকরের ‘কাগজ কুসুম’ কাব্য গ্রন্থ বাংলা কাব্যে বোধ হয় নতুন ধরনের একটি বিষয়। এজন্য এর আলোচনার আগে কবিতা সম্পর্কে গুণীজনদের দু’-একটি অভিমত উল্লেখ করতে হয়। আলোচনা পরিষ্কারভাবে করার জন্যই উল্লেখ প্রয়োজন।
কেউ কেউ বলেন, যথার্থ কবিতার কোনো অর্থ নেই। অর্থাৎ কবিতা পড়তে অর্থ খুঁজে গলদঘর্ম হওয়া বোকামি মাত্র।...
আবার কেউ বলেন, ‘কবিতা সকলের জন্য নয়’।...
আবার কেউ বলেন, কবিতা হতে হবে রুটির মতো সহজ। সবাই যেন তার স্বাদ পেতে পারে।...
আধুনিক দুর্বোধ্য ও অবোধ্য কবিতা সম্পর্কে উ.ঊ. ঝঃরষবিষষ ও কবহহবঃযুড়ঁহম বলেছেন, এসব তো উঁষষ জধননরংয. এসব  উঁষষ জধননরংয এখন আর কেউ পড়ে না। তিনি আরো বলেছেন, এসব দুর্বোধ্য আধুনিক কবিতা হচ্ছে পাঠকদের নাকে-মুখে অশ্বের পাছা পায়ের উল্লাম্ফিত লাথি। পশ্চিমবঙ্গের প্রমথ নাথ বিশিও এই রকম কথা বলেছেন।
‘যথার্থ কবিতার কোনো অর্থ নেই।’
এই অভিমত যদি আমরা মেনে চলতে চাই তাহলে মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ প্রমুখকে কী বলবো? তাদের ঠাঁই কোথায়? আর কবিতা যদি এতো রুটির মতো সহজ হয়ে যায় তাহলে সায়ীদ আবু বকর এবং তাঁর মতো কবিদের স্থান কোথায়? আমার মনে হয় এই সকল গুণীজনের অভিমত একতরফা। এই অভিমত দিয়ে কোনো কবির কবিতার ভালো-মন্দ মান যাচাই করা যাবে না। কবিতার স্থায়িত্ব মান ও মূল্যায়ন করবে মহাকাল। তবে সমকালের পাঠকদের যে কবির যেসব কবিতা ভালো লাগবে সেগুলোই ভালো কবিতা হিসেবে গণ্য করতে হবে।
আবু বকরের ‘কাগজ কুসুম’-এর কবিতাগুলোর সুবাস আছে কিনা, নাকি কাগজের ফুলের মতো সুবাসহীন কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। তাঁর কবিতাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী। কবি নিজেই তার কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নামটার ভেতরে একটা স্যাটার আছে। এ গ্রন্থটি ভারী পাঠকদের জন্যে, এ কথাটি আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই।’
কাগজ কুসুম ভারী পাঠকদের জন্যে লেখা বলেই হয়তো সাধারণ পাঠকদের জন্যে কবিতাগুলো সম্পর্কে কবি অভিমত ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। কবিতার বই প্রকাশ করে বিভিন্ন রুচির পাঠকদের মতামত পাওয়ার আশায় নীরব থাকাই ভালো কবির পক্ষে। যদি কবিতাসম্পর্কে কবি নির্দিষ্ট মতামত বা নোট দিয়ে দেন তবে পাঠকগণ আর স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারেন না।
সায়ীদ আবু বকর তার এ অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘কাগজ কুসুম’ অন্যান্য কাব্য গ্রন্থ থেকে যে ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আমার একটি কাব্য গ্রন্থকে আরেকটি থেকে পৃথক করে ফেলতে। কিন্তু ‘কাগজ কুসুম’ আমার সবগুলো কাব্য গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা ভাষায় এটি একটি নতুন ধরনের কাব্য গ্রন্থ বলে আমি মনে করি। কিছু কিছু পাঠক অবশ্য আমাকে এ ব্যাপারে অবহিতও করেছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে বলেছেন, এটা আমার দীর্ঘদিনের আধ্যাত্মিকতার ফসল। হতে পারে। তবে আমি বলে রাখি, আধুনিকতা বোধের সাথে আমার কোনো কাব্যের কোনো সংঘর্ষ নেই, কাগজ কুসুম-এরও নেই। এপিকের মতো এর কোনো এক কাহিনী না থাকলেও সবগুলো কবিতা মিলে এটি একটি এপিক পোয়েম। এর একজন স্পিকার আছে। সে সভ্যতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু অবলোকন করেছে তা অবলীলায় ব্যক্ত করতে চায়। তার কথার মধ্যে দর্শন আছে। দেশ আছে, পৃথিবী আছে, মানুষ আছে, মানুষের ইহলৌকিক-পারলৌকিক জীবন-জগৎ আছে। এ স্পিকারকে সরাসরি কবি মনে করলে ঠিক হবে না। সে একটি তৃতীয় চরিত্র।’
কবিদের কথায় রহস্যময়তা থাকে এবং কবিতায় রহস্যময়তা সৃষ্টি করে রাখতে চেষ্টা করেন, এ চেষ্টা করে তারা তৃপ্তি পান। কবিরা কখনো একপক্ষের কথা বলেন না। কারণ, কবি হৃদয়ে একই সময়ে প্রতিফলিত হয় সারা সমাজ সমকাল ও পৃথিবী। সমাজে যতগুলো মানব চরিত্র রয়েছে কবির দৃষ্টি তাদের সবার দিকেই এবং তাদের সবার কথাই বলে থাকেন। এজন্য কবির চরিত্র নাটকের একেক চরিত্রের দশজনের মতো হয়ে থাকে। একজন স্পিকারই দশখানে দশরূপে আবির্ভূত হয়ে দশ রকম ভাষায় কথা বলেন। সে স্পিকারকে বাইরের দর্শক বা শ্রোতাদের কাছে দশরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু মূল নায়ক বা স্পিকার একজনই। কবি আবু বকর বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, ‘এ স্পিকারকে সরাসরি কবি মনে করলে ঠিক হবে না। সে একটি তৃতীয় চরিত্র।’ এ কথা মেনে নেয়া কি করে সম্ভব।
কাব্য গ্রন্থের বিশেষত্ব সম্পর্কে কবি বলেছেন,
‘এ গ্রন্থের বিশেষ বেশিষ্ট্য হলো, পাঠকের কাছে এটাকে একদিক দিয়ে মনে হবে গল্পের মতো, আবার অন্যদিক দিয়ে মনে হবে দর্শনের মতো। বাস্তবিকই, আধুনিক জীবনদর্শনই এ কাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, ধর্মহীনতা, প্রেম, প্রেমহীনতা, যাদুবাস্তবতা প্রভৃতি এ কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।’ কাব্যটি পাঠ করলে কবির কথার সঙ্গে সকল পাঠকই একমত হবেন তাতে সন্দেহ নেই। তবু পাঠকদের সামনে সত্যতা প্রমাণের জন্য সামান্য কিছু অংশ তুলে ধরছি:
মানুষ আমাকে বিপ্লবের কথা বলে।
আমি বলি মানুষের প্রথম বিপ্লব হোক
দেশের দেয়াল ভেঙে ফেলা। সীমান্তের
কাঁটাতার ছিঁড়ে ফ্যালো। অতঃপর বিহঙ্গের মতো
পাসপোর্ট ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ো পৃথিবীর দিকে দিকে। মানুষকে
হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে বলো, আমি মানুষের ভাই।.....
(এক দেশ এক পৃথিবী, পৃ. ৪২)
‘সচিবালয়’ কবিতাটি মাত্র সামান্য কয়টি শব্দ রেখায় অঙ্কিত নিখুঁত নিটোল একটি উজ্জ্বল চিত্র। কবি কত বড় শব্দ শিল্পী:
এতদিন কেবল মানুষই উঠতো এ সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায়। কিছু গরু
আজকে হঠাৎ উঠে গেল মানুষের সাথে পাশাপাশি। মানুষের সাথে
কি চমৎকার খোশ গল্প করতে করতে উঠছিল তারা। দেখে বলাবলি করছিল
লোকে, এখনই বরং সুন্দর লাগছে সব; এখনই বরং আদর্শ সচিবালয় বলে
মনে হচ্ছে এ সচিবালয়কে।
(পৃ. সংখ্যা-৬১)
সায়ীদ আবু বকর একজন ব্যতিক্রমধর্মী এবং নতুন নতুন সৃষ্টি কর্মে এডভান্স কবি। তিনি নিত্য নব নব উপাত্ত উপকরণে বাংলা কাব্য ভা-ার সমৃদ্ধ করার চিন্তায় বিভোর। তার রচিত ‘কাগজ কুসুম’ ভাব-ভাষায়, চিন্তা- দর্শনে ও বিষয় উপস্থাপনায় নতুন শব্দ-ছন্দ বাক্য নির্বাচনে শিল্পকর্মের গাঁথুনিতে মজবুত এবং শক্তিশালী একটি কাব্যগ্রন্থ। এ সময়ে এটি উচ্চমানের কাব্যগুণে সমৃদ্ধ ও অতুলনীয় বলতে দ্বিধা নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, কাব্যে ধারণকৃত মূল বিষয়ই দেখা ও বিবেচনার প্রধান বিষয় নয়, প্রধান বিষয় হলোÑ তার পরিবেশনের দিকটি, শব্দ ছন্দময় বাক্য উপমায় উপস্থাপন ও প্রকাশনার চমৎকারিত্বে। দেশ, মাটি, মানুষ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, আনন্দ-বেদনা চিরকাল একই রূপ। জেলের দোকানের সব ইলিশের গুণ একই রূপ। কিন্তু তার স্বাদ নানা রকম রাঁধুনীর গুণে নানা রকম হয়ে থাকে। কাব্য সাহিত্যের বিষয়টিও তেমনি। অতি সাধারণ বিষয় ও ভাবকে অসাধারণ করে তোলার উপরই কবির কৃতিত্ব।
কবি সায়ীদ আবু বকর ধাপে ধাপে কাব্যের সিঁড়ি অতিক্রম করছেন। এটি অবশ্য তার বড় গুণ। তার প্রথম সিঁড়ি ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ থেকে অষ্টম সিঁড়ি কাগজ কুসুমে এসে উঠেছেন। আমরা তার সফলতা কামনা করি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

প্রকাশিত: শুক্রবার ২০ জুন ২০১৪

পারিব না এই কথাটি বলিও না আর - গান: সাবিনা ইয়াসমিন


কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি পরিবেশনে পার্থক্য কতটা? | কবিতার ক্লাস |


Tuesday, January 15, 2019

শামসুর রহমান এর কবিতা: মাতোয়াল রাইত


মাতোয়াল রাইত
-শামসুর রহমান

হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের

লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি

মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা

রাইতের তামাম গতরে। পা দুইটাও কেমুন

আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান

আন্দরমহলের হাটে। মগন জমিনে বান্ধা পাও



আবে, কোন মাম্দির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার

দেহস্ না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;

না অইলে হোগায় লাথথি খাবি - চটকানা গালে

গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলকাছে বেশুমার।



আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের

বাপ, হস্নাবানুর খসম, কয় সুবারাতি মিস্ত্রি।

বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টি দিয়া কয়, তুমি

ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।'



আমার গলায় কার গীত হুনি ঠান্ডা আসুভরা?

আসলে কেউগা আমি? কোনহানতে আইছি হালায়

দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?

চুড়িহাট্টা, চান খার পুল, চকবাজার,; আশক

জমাদার লেইন; বংশাল; যেহানেই মকানের

ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল

মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,

যেমন আধলি একখান দুর জমানার।





আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগেআর

কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর

গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই

এনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান।জানে

হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাটা ফিরা

করে আর রাইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়

বড় ডর লাগে, মনে অয় আমিবি জমিনের

তলা থন উইঠা আইছি বহুৎ জমানা বাদ।



এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা

বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর হইয়া আছে

একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন?

বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে

আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া,

আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।



এহনবি জিন্দা আছি, এহনবি নাকে আহে

গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চানি্ন দিলে

নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ

মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর

আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম

কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।

এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথ্থি দিয়া

মৌত তক সহি সালামতে জিন্দা থাকবার চাই।



তামাম দালানকোঠা, রাস্তার কিনার, মসজিদের

মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের

পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির-

হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব।