Thursday, January 3, 2019

কবিতা এমন – আল মাহমুদ


কবিতা এমন 
– আল মাহমুদ

কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।
কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।

এই কবিতা অবলম্বনে কিছু কথা:
কবিতা এমন যে, তার অন্তরালের কাহিনী বলে কিছু নেই। একটা কবিতার শরীরেই লেগে থাকে কবিতাটির সব ঘটনা। সে ঘটনা পাঠকের উচ্চারণে জেগে ওঠে; পাঠকের হৃদয়ে জমানো স্মৃতি-বিস্মৃতি, দুঃখ-বেদনা-আনন্দের সাথে মিশে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ে একটা কবিতার অন্তর্গত সারাৎসার। কারণ কবি এই জীবনের অনুভবেই স্পন্দিত হন। কবি জীবনের জমানো মুহূর্তকে হৃদয়ের শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেন। আর পাঠক তা মিলিয়ে নেন আপন অভিজ্ঞতায়, সঞ্চয়ে।
আসলে এভাবেই দেখতে দেখতে এবং লিখতে লিখতে আয়ুষ্কাল পার হয়ে যায়। কিন্তু যা দেখেছি তার সবটুকুই তো আর লিখতে পারিনি। তবু জীবনের এইসব দেখা-অদেখাকে প্রকাশ করেছি। সে জন্য বারবার ফিরে এসেছি কবিতার কাছে। আবার কবিতাকেও আঁকতে চেয়েছি নানা রঙে। 
কবিতা এমনই_ এ কথাটি বলতে গিয়েই যেন 'কবিতা এমন' কবিতাটি লেখা। সত্যিই কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি। এ স্মৃতি তো শুধু কবির নয়! কবি শুধু বলতে পারেন, স্মৃতিটুকু ধরতে পারেন শব্দে। এই যে চুলখোলা আয়েশা আক্তার_ এ তো আমার মতো অনেকেরই দেখা। হয়তো কৈশোরে মক্তবে পড়তে যাওয়া সেই মেয়ে, যার কথা কখনও ভুলিনি। যার কথা একজন কবির মতো অনেকেই মনে রাখে যুগের পর যুগ। 
দীঘির জলে ঢিল ছুড়লে যেমন টুপটুপ বুদবুদ ওঠে; কবিতা তেমন স্মৃতির দীঘিতে টুপটুপ বুদবুদ তুলেই এই স্মৃতিমালা তুলে আনে কবিতায়; যেমন হয়েছে এই কবিতায়। 
আমি তো পথে পথে অনেক মানুষ দেখে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি। জগতের সব মানুষের নাম জানার আগ্রহ থাকলেও প্রবল কৌতূহল ছিল না। মানুষের ভিড়ে সবই মানুষ। 
জগৎসংসারকে সত্যের পথে পরিচালনার জন্য সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করেন কবিরাই। 
কোনো পুরস্কারের লোভে নয়, কোনো তিরস্কারে লাঞ্ছিত হয়ে নয়; কেবল মানবিক গুণে ভাষাকে সজ্জিত করার অভিপ্রায়ে।
কবিতা অমর অমোঘ সত্যেরই অপর নাম। 
হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, পার হয়ে যাচ্ছি সারাটা দুনিয়া। একই সঙ্গে পার হয়েছি জীবনের কত দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-উদ্দীপনা! তবুও আমার হাঁটার নেশা ফুরায়নি। শুধু যে হেঁটেছি; এমন নয়। নিজেরই অতীত ঘেঁটে বর্ণনা করেছি পথ পাড়ি দেওয়ার বিশাল তেপান্তর। কত ইতিহাস, কত ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাকে চলার পথে প্রতিবন্ধকতা দিয়েছে! আমি সেইসব বাধা তুচ্ছ জ্ঞান না করেও ধীরে-সুস্থে পা তুলে দিয়েছি বিপদের উপত্যকায়। তারপর এক পা-এক পা করে এগিয়ে এসেছি পেছনে রেখে কত বিপদের ঘনঘটা, কত সুখ এবং পুলকের উপলব্ধি!
কবিতা মানুষের মনে এই বিশ্ব, মহাশূন্যতা ও অন্তহীনতার যে ধারণার সৃষ্টি করে, তা চোখ বুজে কেবল উপলব্ধি করা যায়। মনে হয়, শেষ নেই। কোনো কিছুরই শেষ নয়। 
ছেলেবেলায় জন্মদিনটি এলেই মা কাছে ডেকে বলতেন, এক বর্ষণের রাতে নাকি আমার জন্ম হয়েছিল। আমি এ কথা শুনে একটু কেমন যেন অবাক হয়ে যেতাম এবং কানে এসে লাগত বারিবর্ষণের ক্রমাগত শব্দ। আজও সেই স্মৃতির কথা মনে হলে আমি ভাবি_ আমি কবি না হয়ে যদি অন্য কেউ হতাম তাহলে কী হতো! মুহূর্তেই মনে হয়, আমি কবি না হলে হয়তো কিছুই হতাম না। তবু আমার মনে এই ইচ্ছা প্রবলভাবে আমাকে আপ্লুত করে রাখে_ আমি কবি না হলে সঙ্গীতজ্ঞ হতাম। কেন এ কথা মনে হয়, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আমি খুঁজে পাই না বটে। তবে অনুরাগ ও অনুশীলন কিছু হলেও ছিল সঙ্গীতের প্রতিই। আমার পিতাও ছিলেন সঙ্গীতের অনুরাগী একজন মানুষ। তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে মাঝে মাঝে গেয়ে উঠতেন_ 'আমার মনের হরিণ হারিয়ে গেছে এই মহুয়া বনে'। তার সেই চিকন কণ্ঠস্বর এখনও আমার স্মৃতির ওপর সুরের তরঙ্গ তুলে মিলের দিকে মিশে যায়। 
দুঃখ ভোলার জন্যই অনেক সময় আমি আমার সৃজন স্বভাবকে সজাগ-সচেতন করে প্রদীপের মতো জ্বালিয়ে রাখি। মনে মনে বলি, অন্ধকার কালো হোক নীল হোক আর যে রঙই ধারণ করুক; আলোর সামনে সব কালোই আলো হয়ে যায়। এভাবে আমি চিরজীবন আমার ভেতরে ব্যক্তিসত্তার প্রদীপ প্রজ্বালন করে আলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছি। মনে মনে ভেবেছি, এই তো জ্বলে উঠেছে আমার অন্তরাত্মা। দেখতে আলোর মতো পরিতৃপ্তিকর ও সতত সান্ত্বনাদায়ক। 
সবকিছুই আমি ভেতরের শক্তি দিয়ে অতিক্রম করে এসেছি। যেখানে আমার বিরুদ্ধে কিছু মুখ উত্তেজিত হয়েছে, আমি সেখান থেকে এক পা-এক পা করে হেঁটে হয় পিছিয়ে গিয়েছি কিংবা পার হয়ে চলে এসেছি। আমি দুঃখেও থাকিনি। আনন্দ বা সান্ত্বনার মধ্যেও ঠাঁই খুঁজিনি।
যদি আমি কবি না হতাম তাহলে সত্যি কোথাও লুকিয়ে থাকতাম। গাছের নিচে পাতার আড়ালে ঘাসের কাছাকাছি মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকতাম।
জয়ের মাল্য আমার সামনে মাটিতে লুটানো পড়ে থাকে। আর আমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে সেটি তুলে গলায় পরতে বাধা দেয়। আমি পারি না, আমি ধরিও না। তবে দৃশ্যটা আমি আমার মনে ভাঁজ করে রেখে দিই। আর চুলখোলা আয়েশা আক্তার? যে অক্ষয় হয়ে আছে এই মর্ত চোখে; সামান্য কবিতায় ... তার কথা গদ্যে আমি কী করে বলব, হে পাঠক? (গ্রন্থনা ::সঞ্জয় ঘোষ)



কবিতাটির আবৃত্তি:

No comments:

Post a Comment