Saturday, January 5, 2019

মাসুদ খান-এর দীর্ঘ কবিতা ‘প্যারানরমাল’

‘প্যারানরমাল’

           -  মাসুদ খান

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি করে খোঁচাচ্ছে অযথা।
ঘাবড়ে যাচ্ছে তোতা।

অজস্র বিমান ওঠানামার মাঝেই 
গা-ছমছমে ভূতের গল্প জেগে ওঠে ঝলমলে বিমানবন্দরে।
রানওয়ের দুই পাশে ফুটে-থাকা বিন্দু-বিন্দু আলোকপুষ্পের মধ্যে
অনেকগুলিই আর আলো নয় তখন, আলেয়াবিশেষ। 
হঠাৎ হালকা এক অনুনাসিক সুর, 
আধাজবাই-করা হলকুম-উপচানো ঘ্যাঁসঘ্যাঁস শব্দ আর 
টুটাফাটা-ফুসফুস-নির্গত কিছু প্রাচীন নিশ্বাস ভেসে আসে অমর্ত্য, ইথারিয়াল...
কোনটা ভূতার্থ দ্যুতি, কোনটা আলেয়া, কোনটাই-বা অলোকশ্রবণ-- 
ধোঁয়াশায় ভেজা সব।

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি ক’রে খোঁচাচ্ছে অযথা।
ভড়কে যাচ্ছে তোতা।

আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব দীর্ঘপাদ পাখি, 
আবার সে-গোয়েন্দা গিরগিটি, খররোমা, দীপ্তাক্ষ বেড়াল
শহরের ব্যস্ততম সড়কে উটপাখিতে চড়ে উদলা-গায়ে 
শ্লথ-প্লুত গতিতে এগিয়ে চলছে এক কৌপীন-পরিহিত বহিরাগত। 
হঠাৎ সামনে পড়ে-যাওয়া এক লিমুজিনকে দেখে বলছে,
“বাহ! কী সুন্দর বাহন!” 
অমনি খেপে গিয়ে তেড়ে আসছে লিমুজিন, বহিরাগতের দিকে। 
বিস্মিত কৌপীন। হ্যাশট্যাগ আজগবি আগন্তুক।

এদিকে রাস্তার মাঝখানে আচমকা হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে 
‘আউচ’ শব্দে অন্তিম হিক্কা তুলে মারা গেল এক বয়োবৃদ্ধ আউডি। 
ডোম ডাক্তার পুলিশ দমকল বিমা ও বিবেকমতি...ছুটে এসেছে সবাই।
রিসাসিটেশন, রিসাসিটেশন। কাজ হচ্ছে না। যানজট।

চিকিৎসা হবে বাহনের, নাকি অন্তিম সৎকার-- বিভ্রান্ত সবাই। 
ভাগাড়ে নেবার লাশবাহনও প্রস্তুত।

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি ক’রে খোঁচাচ্ছে অযথা।
ওই তো আবার ঘাবড়ে যাচ্ছে তোতা।

সামনে সুমেধা সাগর, পেছনে শ্রীভ্রষ্ট মরুভূমি। 
এক কোণে ছোট্ট মরূদ্যান-- 
কাঁটাঝোপ, ক্যাকটাস, দুয়েকটি গন্ধকরঙিন বৃশ্চিক, সরীসৃপ
যেন শূন্য প্রান্তরজুড়ে বিছিয়ে-রাখা বিশাল তুলোট কাগজের খাঁ-খাঁ পৃষ্ঠা
নিচে একপাশে হিজিবিজি দুরক্ষর দস্তখত।
তৃষ্ণা পেলে মুসাফির এক আঁজলা আগুন-মেশানো মরীচিকা 
পান করে পাড়ি দেয় মরুভূমি-- বিষণ্ন, অনাথ। 
না না, এ তো প্রকৃতির স্পষ্ট ব্যভিচার এই সান্ধ্য-সলজ্জ অধিবেশনে! 
ওই ছোট্ট মরূদ্যানটুকু যেন তার সবশেষ-সমঝোতা-- 
কিছুটা লৌকিক বটে, অনেকটাই অপ্রাকৃত। হ্যাশট্যাগ অজাচার-অভিচার।

ওই মরূদ্যান যেন আদিগন্ত বারোটা-বাজিয়ে-রাখা ব্যভিচারের দায়ে
নিসর্গের কাছ থেকে জোর-করে-নেওয়া শাদা কাগজে স্বাক্ষর।

এবার বলুন, কোন উপচারে, অভিজ্ঞানে, কোন কলনবিধিতে 
সমাধান হবে এইসব গূঢ় সমাকলনের?

ভ্রুকুণ্ডা ঘাসের বীজ বিঁধে আছে পোশাকে তোমার
তুরীয় মস্তিতে মওলা মুর্শিদ মুরিদ সব একাকার
মাস্ত মওলা মাস্ত কালান্দার 
যুগলনিয়তিবন্দি ফুল ও ভ্রমর, অনিবার্য ওই ভ্রামরী মিত্রতা
অজ্ঞেয় আসক্তিবশে।

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি ক’রে খোঁচাচ্ছে অযথা।
মাঝে মাঝেই ঘাবড়ে যাচ্ছে তোতা।

জিরাফের উচ্চ চিন্তা আর কোনোভাবেই পৌঁছায় না মেষশাবকের কাছে। 
দিকে দিকে অপভ্রংশ, অভিচার, ব্যতিহার মানচিত্র-- ঝাপসা, জটিল, দুরধ্যয়। 
জাতিবৃক্ষে ফোটে ফুল, ডালপালা ভরে ওঠে লক্ষকোটি জাতিফলে-- 
টক-মিষ্টি-কটু-ও-কষায়। চিরবসন্ত, চিরহরিৎ। 
ঝরে না কোনো পাতা, খসে না কোনো বাকল। হ্যাশট্যাগ জাতিবৃক্ষ।

বহুপর্ণা সে-জাতিগাছের কোটরের ভেতরে কোকিলাসনে আসীন 
মকর-ত্বকের-কোট-পরা এক মেদমন্থর বানর। 
কড়কড়ে ডলার গুনছে আর পটাচ্ছে বরিষ্ঠা বানরীকে।

নিচে কত কষ্টে থাকে 
দুস্থ শেয়াল সারমেয় বনবিড়াল কুরঙ্গ ও মিয়ারক্যাটেরা! 
তারা দরবিগলিত চোখে ও চিত্তে সামনের দু-পা তুলে তাকায় 
ওপরের দিকে। টুপটাপ খসে পড়ে দু-একটি ডলার। 
সমষ্টির স্বাস্থ্যে ব্যষ্টির ব্যাধি নিরাময়, নাকি 
ব্যষ্টির অসুখ সারলে সমষ্টির স্বাস্থ্য হয়-- 
এ-সবই গোলচক্র গোলকধাঁধা।
তবে রোবটদের পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে জেনে বিরক্ত সবাই। 
দোষ আর রোষ একসঙ্গে গিয়ে পড়ছে মুখপোড়া হনুমানের ওপর। 
হায়! এ কেমন রোষাত্মক জ্ঞাতিতোষ, শিবাশিবচক্র! 
ইতিহাস মেরামত হচ্ছে ল্যাবে, পরিমাণমতো ট্রুথ সিরাম মিশিয়ে। 
হ্যাশট্যাগ ট্রুথ সিরাম।

অদূরে যুগলকণ্ঠে গান হচ্ছে: 
“তোমার গলি খুঁজতে গিয়ে পেলাম আমার ঘর
তোমার খোদা খুঁজতে গিয়ে মিলল আমার রব
তোমার যোজনগন্ধার ঘ্রাণ জাগিয়ে রাখে সব
বিজলি হয়ে পড়ব যখন, বুঝবে উপদ্রব।”

প্রেমগান হচ্ছে, কিন্তু প্রেম হচ্ছে না। 
কিরণ বিনিময় হচ্ছে, কিন্তু সে-কিরণ নিস্তেজ, নিস্তেজস্ক্রিয়।
দুটি শব্দ হতে চায় এক শব্দ, সুচারু সমাসবদ্ধ, 
কিন্তু হায়, হয়ে যায় হাইফেনে সিদ্ধ। 
আস্ফালন, স্বরাঘাত, শ্বাসাচার, নিপাতনে সিদ্ধ লঘু পরিহাস।

এইমাত্র ভাগাড়ে বিধ্বস্ত হলো বোমারু বিমান। 
সঙ্গে সঙ্গে কি-জানি কোত্থেকে একঝাঁক ডোমকাক এসে 
ডাইভ দিয়ে পড়ল বোমারুর দাউদাউ ভগ্নাংশের ওপর। 
মহাকাশ থেকে অহেতু স্ফুলিঙ্গসহ ঝরতে থাকল 
অজস্র আসমানি কমা ও সেমিকোলন, দস্তাকণা, বকেয়া বিস্ময়চিহ্ন।

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি ক’রে খোঁচাচ্ছে অযথা।
ওই তো আবার ভড়কে যাচ্ছে তোতা।

কবুতর। নাম ভল্লাতক। কারা যেন পুচ্ছে ও পালকে তার 
বাইশবার কৌশলমন্ত্র পড়ে ছেড়ে দিয়েছে ভবিতব্যের দিকে। 
আজন্ম উড়ছে আর ঘুরছে কবুতর, 
উড়ে-ঘুরে মরছে, ভগ বা ভবিতব্য মিলছে না কিছুই।

শীতের রাতে অচেনা দুয়ারের সামনে ফেলে-রেখে-যাওয়া নবজাতক 
বড় হয়ে একদা বেরিয়ে পড়ে বেরহম বাবামায়ের সন্ধানে।
নিশ্চয়ই রয়েছে কোথাও-না-কোথাও এক দ্বিতীয়রহিত জায়গা 
যেখানে এসে মিলিত হয় হাহাকার করতে-করতে-আসা 
দুনিয়ার যত দয়ামায়াহীন পিতামাতা আর পরিত্যক্ত সন্তানেরা,
এমনকি নর্দমায় ছুড়ে ফেলে-দেওয়া পলিথিনবদ্ধ ভ্রূণেরাও। 
জড়িয়ে ধরে তারা পরস্পরে
ফেলে দেবার জন্য বারবার ধন্যবাদ দেয় বিগলিত বাবামাকে।

পাঁচ ধাতুতে তৈরি খাঁচা তার ভেতরে তোতা
ছয়টা চোরে যুক্তি ক’রে খোঁচাচ্ছে অযথা।
ঘাবড়ে যাচ্ছে তোতা।

মত্ত ড্রামারের হাত থেকে ছুটে-যাওয়া-ফের-ধরে-ফেলা যুগলকাঠির আবেশে 
কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বয়ংক্রিয় উন্মাতাল বাজতে থাকবে ড্রাম, 
ড্রামারের হতভম্ব দু-হাতকে হাজিরনাজির মেনেই। 
লৌকিক এপিসোড হয়ে উঠবে অলীক অলৌকিক। 
সমগ্র সংগীতসন্ধ্যা একটু একটু করে হয়ে উঠবে
খর অপিনিহিতি পেরিয়ে আসা এক নম্র অভিশ্রুতি।

এই তো ধীরে ধীরে রসাগম হচ্ছে পাঠবস্তুতে। 
রূপ আসছে, রূপক আসছে, অলংকার-ঠিকরানো দ্যুতি আসছে, 
ছন্দও আসছে চুপিচুপি। ছন্দশ্চ্যুতি, সেও। 
আসছে ছন্দছুপানো কৃৎকৌশলও।

রসাধিক্যে ভোগার আগেই কোরো রসসংযম। 
তা না হলে রসোত্তীর্ণ হতে হতে হয়ে যাবে বেসামাল, রসজীর্ণ।
হ্যাশট্যাগ রসাধিক্য।

এবার দেখুন
ছয়টা চোরে দাবি করে খাঁচার মালিকানা
দখলদারি মারামারি অনিবার্য, জানা। 
সূর্য তেতে ওঠার আগেই উড়াল দেবে তোতা
দেবেই দেবে, হবে না অন্যথা।

আবার তোতা আসবে নাকি ফিরে
আগমনিগম চক্র তবে ঘুচবে কেমন করে!?

No comments:

Post a Comment