নোমান সাদিক : বিশেষজ্ঞরা বলেন কবিতার আসলে অনুবাদ হয় না। রবীন্দ্রনাথের মতে, বাছুরের চামড়ার ভেতর খড় ভর্তি করে নকল বাছুর তৈরি করার চেষ্টা। তাই মনে হয় মূল কবিতার ভাব, অলংকার ও শব্দকে অন্য ভাষায় হুবহু বা কাছাকাছি রুপান্তরে স্বার্থকতার আশা বড় ধরনের জুলুম।
তবুও অনুবাদ প্রয়োজন। চিন্তার ও ভাষার দৈন্য কাটাতে, অপরিহার্য কারণে অনুবাদ করতে হয়। এর মাধ্যমেই পাঠক অন্যভাষার কবিদের চিন্তাকেও আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। এর চেয়ে বড় কথা অনুবাদ না করেইবা কি উপায়? বহুভাষা শিক্ষা করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
যিনি যতোটা অনুধাবন করেন তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন নিজ ভাষাভাষীদেরকে তা অনুধাবন করানোর। কখনো কখনো যে অনুবাদও আরেকটা মৌলিক সাহিত্যে হয়ে যায় । যেমনÑ নজরুল অনুদিত খৈয়াম ও হাফিজের রুবাঈ, কৃত্তিবাসের রামায়ন এবং আলাওলের পদ্মাবতী।
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের নব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি সায়ীদ আবুবকর। তার মৌলিক সাহিত্যকর্ম তথা কবিতা পাঠক ও সমালোচক মহলে আলোচনার বিষয়। এখানে তার অনুবাদ কবিতা নিয়ে কথা। তিনি বাংলাভাষায় মাইকেল মধুসূদন এর ইংরেজী কবিতার সার্থক অনুবাদক।
নির্বাচিত বিদেশী কবিতা তার অনুবাদকর্মে নতুন সংযোজন। দুফু, রাবেয়া বসরি, রুমি, হঙউ, জেফারসন, জন টেইলর, শেলি, ইয়েটস, ক্রেইন, জিয়া গোকালপ, ইকবাল, খলিল জিবরান, উম্মে কুলসুম, নাজিম হিকমত, নেরুদা, ফয়েজ আহমেদ, তুরহান জেদ, লু লি, মুস্তাই, ভেগাবজেদ, গুন্টারগ্রাস, মায়া এঞ্জেল, শেস্তিনিস্কি, কে ইয়ান, ঝো লিং, আচেবে, ট্রান্সমোর, তুমান বাই, দারবিশ, এ পি জে আব্দুল কালাম, হাসান নাজাফি, ববডিলান, নরেন্দ্র মোদি, ফাতিমা বাকি সহ মোট উনচল্লিশজন কবির আটান্নটি কবিতা রয়েছে। সবগুলো নিয়ে আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। বেছে বেছে সেসব থেকে ধরা কয়েকটি কবিতা-
অষ্টম শতকের চিনের বিখ্যাত কবি দু’ফু’র কবিতাটির চমৎকার অনুবাদ হয়েছে।
একটি লাইন এমন-‘ভাইসব, নেমে এসো, চলো দেখি বর্ষার লাল আলো’।
রাবেয়া বসরির চারটি কবিতার অনুবাদই সাবলীল হয়েছে। যেন মৌলিক।
বাংলাভাষায় মোটের ওপর অনুবাদের সংকট। আর যথার্থ অনুবাদের তো আছেই। কিন্তু রুিমর কবিতা যখন সায়ীদ আবুবকর এভাবে বললেন-
‘হে চাঁদমুখ প্রিয়তমা,
রোজার মাস এসেছে
টেবিল ঢেকে ফেলো
এবং খুলে দাও প্রশংসার পথ।’ তখন শিরোনাম না রাখলে মনে হবে যেন মৌলিক।
আরেকটি বৈশিষ্টম-িত অনুবাদ হলো হঙ উ (১৩২৮-১৩৯৮) রচিত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে নিয়ে ‘রসুল প্রশস্তি’ কবিতাটি। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উচ্ছসিত প্রশংসা করা হয়েছে। একটি পংক্তি হলো-
‘তিনি পাড়ি দিয়ে এসেছেন গৌরবময় সব পথ’।
জিয়া গোকালপ এর বিখ্যাত কবিতাটি ‘মিনারগুলো বেয়নেট আমাদের’ শিরোনামে অনুদিত হয়েছে। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি তথা নির্য়াতিত মানুষের কবি মাহমুদ দারবিশের ‘পাসপোর্ট’ কবিতাটি আরো কয়েকজন অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু সায়ীদ আবুবকর এর অনুবাদ একেবারেই ভিন্ন।
আমাদের দেশে যাকিছু অনূদিত হয়েছে তা বেশিরভাগই পাশ্চাত্য সাহিত্য। তা যে মানেরই হোক না কেন। কিন্তু গোটা মধ্য এশিয়াই যেন অনাবিষ্কৃত ও অর্ধআবিষ্কৃত পড়ে আছে। দুঃখজনক যে, প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যেমন ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকার সাহিত্য বিশেষ করে সমকাল তারা কি ভাবছে তা জানার কোন চেষ্টাও করছি না কেউ। অথচ সংঘবদ্ধ থাকলে এসব ভাষাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে ভিন্ন জোয়ার আনা যেত। সায়ীদ আবুবকর এক্ষেত্রে একটি যুগোপযোগী কাজ করেছেন। ইরানের খোমেনি, নাজাফি, আরব আমিরাতের খালিদ আল বাদুর, অন্যদিকে ভারতের এপি জে আবুল কালাম, বিক্রম শেঠ, নরেন্দ্র মোদী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), ভুটানের ভক্ত রাজগীরীর কবিতাও আমাদের কাছে আমাদের ভাষায় এনে দিয়েছেন। জানি এটা অপ্রতুল। তবু অপরিহার্য।
এসব বিবেচনায় কাজটি সময়োপযোগী ও সুখপাঠ্য।
তবে, এত ভালোর মধ্যেও আমার মনে কয়েকটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। যেমন বব ডিলানের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে যেহেতু সেটা গান। তাতে রিপিটেশন আছে। এ সংকলনে যে চারটি গানের অনুবাদ আছে সেগুলোকে গদ্যছন্দে না নিয়ে স্বর বা মাত্রাবৃত্তে হয়ত নিতে পারতেন। গদ্যছন্দে রিপিটেশনকে ঘুমন্ত নদীর মতো লাগে। ছন্দে যেটা জীবন্ত থাকতো । আমরাও দ্যোতনা পেতাম। মৌলিকত্ব কতটুকু, সার্থক হয়েছে কিনা, সেসব বিচারের ভার আমার নয়। আমি পাঠক । আমার ভালো লাগলেই হলো।
নির্বাচিত বিদেশী কবিতা
লেখক : সায়ীদ আবু বকর
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বইমেলা।
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৭২
প্রকাশনী : ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স
প্রচ্ছদ : সাইফ আলি
No comments:
Post a Comment