মৌনতা
- বীরেন মুখার্জী
১.
শূন্যে ভাসাই মৌন চুম্বন, যুক্তি-তর্কে কাদামাটি দেহ
সংগোপন ভূমিকা ছাড়া সবকিছুই মুখরোচক
ছুটিবারের প্রশান্তিটুকু অবহেলায় উড়িয়ে
কীভাবে জাগাবে তুমি যাপনের সুখ!
আমার মধ্যে খেলা করে হেমন্তের গোধূলি
পাতাবিহীন গাছে গাছে সুর তোলে শিশিরের দিন
ও নদী তুমিও ঢলে পড়ো
পলাতক রোদের মতো—সংস্করণহীন!
২.
কিংবা নিঃস্বার্থ রাত, গলে যাক চাঁদের কুহক
ক্রমশ আয়ুষ্মান হয়ে উঠুক আলোকের অমেয় সংবেদ
ফলিত রাতের অক্ষরে আমিও আছি অচেনা অন্ধবাদক
জ্যোৎস্নাচূর্ণ মোহে পোড়াতে রাতের তামাশা!
আমাকে প্রণয়ী করে ছুটে যায় যে বিকেলের নদী
গমন পথে তার প্রকাশ্যে ডুবে মরি
…………….পান করি, শ্লেষ ও সভ্যতার বহুমুখী তরল
আমি তো জ্বেলেই রেখেছি, বায়ুশূন্য জীবনের ধুপ!
৩.
ঋতুসন্ন্যাসে যাবো ভাবতেই তোমার চোখে
ডানা মেলে অন্তহীন শূন্যায়তন, কেঁপে ওঠে আত্মপ্রতিকৃতি
ইন্দ্রিয়ের পিচ্ছিল সরণি বেয়ে নিঃশব্দে
ঢুকে যায়—ব্যক্তিগত আঁধারে!
একদিন যে চাওয়ায় গভীর হয়েছে রাত
আমি তার ব্যথা ও ব্যঞ্জনার রাজসাক্ষী
ঋতু বদলের নির্দেশে এখনো প্রবহমান
সংলাপের সারবত্তায় ভুলে আছি—চাষের ইতিবৃত্ত!
৪.
মাথার মধ্যে নড়ে ওঠে অলৌকিক শুঁয়োপোকা
বিশ্বাস পতনের শব্দে উড়ে যায় পালিত ঘুম
অপেক্ষার বাঁশি বাজে রক্তকোষে, হতে পারে
তোমাকে অনুভব করেই রঙ বদলায় ঝরাপাতা;
পৃথিবী জানে, পরিবর্তনের স্খলিত ইতিহাসে একদিন
জমা হবে পাপ ও পুনর্জন্ম। সম্পর্কের ভেদাভেদে
কীভাবে বদল হয় গোপন সৌন্দর্য—জানে প্রেম;
তবু এই দীর্ঘ পর্যটন, গলে যাই নিঃশব্দ রুমালে!
৫.
মুছে ফেলা নামের গৌরব থেকে, প্রস্তাবিত যে প্রত্যয়
জেগে উঠেছিল দেহখণ্ডে, তার বাৎসল্যমূর্ছনা নিয়ে
উড়ে গেছে স্বপ্নভূক পাখি, অসমাপ্ত দৃশ্যে যার
কেবলই লিপিবদ্ধ হয়, বিফল জ্যোৎস্নার স্বরলিপি!
জানি, হৃদয়প্রান্তর ছেড়ে যাবে দগ্ধ প্রজাপতি
পৃথিবীর যাবতীয় ভুল হেঁটে যাবে সত্যের পথে
পৌরাণিক বাগধারায় রচিত কর্মশালা—বৃথা হবে সব
প্রতীক্ষায়ও থামবে না আর চলমান সময়ের গাড়ি!
৬.
অর্থহীন উপাখ্যান লুকিয়ে রাখা ওই চোখ জ্বলে ওঠে
অপাঠ্য আঁধারে; আড়ালের মন্ত্র শিখে নেয়
প্রাচীন গাছের পাঠশালা, আমি কী তারই ঝরাপাতা
মর্মর ভুলে—ভুল সংগীতে কুড়াই জীবনের মানে?
তবু ভুলের অতলে অপেক্ষমাণ দিন—ভুলের খনিজ!
আঁটোসাটো পাখির ঠোঁটে যে সান্ত্বনা রাখি রোজ
মিহিসুরে বাজে তার ডানার উড়াল, গন্তব্যহীন—
বহু উৎসে ঢেকে রাখা বিশ্বাসের ছাপচিত্র ভেঙে!
৭.
কখনো রোদের চুম্বনে ভাঙে ঘুম—বিঁধে চোরকাঁটা
নিয়তির দোষ দিয়ে কতটুকু প্রশস্তি মেলে আর
সেই তো বৃত্ত ভাঙার খেলা অহর্নিশ, বোধের রহস্যসুধা
কেন থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে চিরকাল!
একদিন সমুজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে হেলে যেতে পারি
তুলে নিতে পারি মহামহিম ঐশ্বর্য—মাটির কীর্তনে
না হয় ঈশ্বরই লীন হোক পোড়া আত্মায়
অক্ষরের উৎসব হোক জমকালো—শবরেণু মেখে।
৮.
দিনশেষে প্রান্তরের কোনো হিসেব রাখেনি ঝরাপাতা
গন্তব্য না জেনে উড়ে গেছে অজানা-অচেনা পথে
সংকল্পগুলো নিরবচ্ছিন্ন নিয়তির মতো, দোদুল্যমান
যেন শেষদৃশ্য! ঝুলে আছে বায়বীয় তারে!
জানি, যেতে হবে আরও বিরহ দুপুর পায়ে হাঁটা পথে
তারপর হেমন্তের শেষ পৃষ্ঠা—প্রণয়নগরী;
তবে কেন এই অব্যক্ত ভ্রমণ টেনে আনে আঙুলের ফাঁদ
শৌখিন অশ্রু ছড়ায়—অসম সঙ্গীতে!
৯.
এলোমেলো কৈশোর হারিয়ে ফেলেছি নগরের পথে
পাতা কুড়াবার লোভ, শিশিরে ভেজা পথ ভুলে গেছি সব
এখন গোধূলির রঙে মিশে যাওয়া ভাঁজপত্র খুলে দেখি
খাদে খাদে জমে আছে—সময়ের ঋণ!
তবু এই ইচ্ছেহীন ডাকাডাকি থেমে গেলে একদিন
নিয়তির নির্দেশে সঙ্কোচিত হবে হৃদয়ের টান
সূচনা থেকে গন্তব্যের পথে এঁকে রাখা মোহময় কথা
উড়ে যাবে একদিন—একতরফা ঘুমের হিসেবে।
১০.
প্রতিনিয়ত ভেঙেচুরে যাচ্ছে গোপনবিন্দুর প্রতিফলন
চিত্রকল্পের মায়া নিয়ে নাগালের বাইরে যেতে যেতে
হারিয়ে যাচ্ছে—সুগন্ধসারাংশ; ইশারার বিভ্রমে
গলে যাওয়া এই চোখ কতটুকুই বা প্রতিরোধকামী!
মঙ্গলের দড়ি বেয়ে কেঁপে ওঠা রাত ট্যাবুর কলোনি
সুতীব্র আলোর নেশায় ঘুম উড়ে গেলে
চোখের মিছিলে রাতভর বাজে—স্পর্শসমগ্র তোমার
মাতাল হিসেব ভাঙে তন্দ্রালু চোখের মৃদু কলরব!
১১.
বিশ্রামের নির্জনতায় ভুলে গেছি যে কবিতা
বাসি হতে পারে সে হিসেব একদিন; টোটেমসমৃদ্ধ বৃক্ষলিপি
হতে পারে পর্ণরাজিপূর্ণ, তবু সারিবদ্ধ গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে
সন্দেহ কাঁধে নিয়ে শুনি—দূরাগত বিস্ময়ের ধ্বনি।
এখন সঙ্কোচিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে অপক্ব ফলের নির্যাস
খুচরো বোধ নিয়ে অনন্তের দিনগোনা—মিথ্যের সাঁকো
আলোর স্নিগ্ধতা খুঁজতে এসে দেখি সাদাপৃষ্ঠাজুড়ে আছে
বহুবর্ণ মোহ; আমাকে নিংড়ে তোলা বাতাসের খ্যাতি!
১২.
আমাদের গায়ে ঠেস দিয়ে রোদ পোহানো হেমন্তের নদী
অবশেষে খুলে দিয়েছে অপার রহস্যদুয়ার, এখন স্বাধীন তুমি
পালকমুক্ত করে ভেসে যাও প্রতীক্ষিত পথে
আমার এ সাঁতার উদ্দেশ্যহীন—বোধন কিংবা বিসর্জনে
শিল্পের পাপে মোড়া এ দেহ; কোনো প্রদোষবেলায়
সামনে দাঁড়াই যদি, যদি দাঁড়াই জীবনপঞ্জি খুলে
ভ্রমণের নিরেট ব্যঞ্জনা কিংবা সহস্র অক্ষরে গাথা বোধ
উড়ে যাবে, সঙ্গীতের তুমুল হাততালি মেখে।
১৩.
দিনশেষে বিশীর্ণ সংসারে দেখি অজ্ঞতাই পুঁজি
অপভ্রংশ প্রেম তবু উঁকি দেয়, প্রণয়কাতর চোখ
হৃদয়ের গোপনে ভাঙে সেইসব স্মৃতির লিপি
মননের প্রগতি বেয়ে উঠে যায় নিয়তির হাতে।
পকেটে রেখেছি পুষে স্বপ্নদৃশ্যের ঘোর, শেষ চিত্রপট
ভেসে যাই—ডুবে যাই, আমূল বিদ্ধ হই যুক্তি-তর্কে
উড়ে যায় ব্যথাতুর চুম্বনের দীর্ঘ স্বরলিপি
সারথি, আমি তো যুদ্ধেই আছি—বিভ্রম আর পরাজয়ে!
................................................................................
নব্বইয়ের সময়পর্বের অন্যতম কবি বীরেন মুখার্জী। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প ও কলাম লিখেন। গবেষণা করেন তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— উদ্ভ্রান্ত সময় (কবিতা ১৯৯৮, কলকাতা), প্রণয়ের চিহ্নপর্ব (কবিতা ২০০৯), প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস (কবিতা ২০১১), নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণ (কবিতা ২০১২), পালকের ঐশ্বর্য (কবিতা ২০১৩), মৌনতা (দীর্ঘ কবিতা ২০১৩), জলের কারুকাজ (কবিতা ২০১৪); প্রকাশিত প্রবন্ধের বই— কবির অন্তর্লোক ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১২), বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য (সম্পাদনা ২০১৪), সাহিত্যের প্রতিপাঠ (২০১৪)। সম্পাদনা করেন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪)। বীরেন মুখার্জী পেশায় সাংবাদিক, বর্তমানে যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।
No comments:
Post a Comment