আবদুল হালীম খাঁ : কবি সায়ীদ আবু বকর এর ‘কাগজ কুসুম’ কাব্য পাঠ করে আমার কবি আবদুস সাত্তার অনূদিত জীবরান খলীল জীবরানের গদ্য রীতিতে লেখা কাব্য ‘রামালু ওয়া জাবেদা’ (বালি ও ফেনা)-এর কথা মনে পড়ছে। বালি ও ফেনা এবং কাগজ কুসুম এর বিষয় অবশ্য ভিন্ন। ‘বালি ও ফেনা’ কবিতার হেডিংহীন একটানা শেষ পর্যন্ত গদ্য রীতিতে লেখা। কাগজ কুসুমের প্রতিটি কবিতার নাম রয়েছে এবং একটানা গদ্যে লেখা।
দু’টি কাব্য সামনে রাখলে মনে হয় দু’কবির চিন্তাভাবনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে যথেষ্ট মিল রয়েছে এবং সে মিলটা খুব কাছাকাছি। মানব হৃদয় দর্পণে সমকালীন সমাজ ও পৃথিবীর যেমন ছায়া পড়ে সেই ছায়ার মতো। জীবরান লিখেছেন:
আমি চিরদিন এই সমুদ্রের তীরে ভ্রমণ করবো
এই বালি এবং ফেনার মধ্যে।
উন্মত্ত জোয়ার এসে আমার পায়ের দাগ মুছে ফেলবে
দুরন্ত ঝড়ো হাওয়া নিশ্চিহ্ন করে দেবে সকল ফেনা,
কিন্তু এই সমুদ্র এবং সমুদ্রের তীর
অনন্ত কালের ঘরে বর্তমান থাকবে।
(বালি ও ফেনা-পৃ:-১)
কবি সায়ীদ আবু বকর লিখেছেন:
এই নীল সমুদ্র শয্যায়
শুয়ে আছে সহ¯্র মানুষ। শুয়ে আছে নাকি
ডলফিন মৎস্য কন্যাদের সাথে নেচেনেচে গান গায়
সোনালী রূপালি জলের গহিনে, যখন ক্রীড়ায় মত্ত সব বসন্তের পাখি
ঝাঁক বেঁধে চঞ্চল চঞ্চুতে নিয়ে যায় তুলে ধবধবে সমুদ্রে ফেনা?
(সমুদ্রের গান,-পৃ. ৬২)
উদ্ধৃতি না বাড়িয়ে সমগোত্রীয় আরো কয়টি কবিতার নাম উল্লেখ করা যায়। যেমন- দিব্য দর্শন, ভয়, নাটকের মতো ইত্যাদি। বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে কিন্তু বিষয় উপস্থাপন ও বর্ণনা ভঙ্গিটা উভয়ের কাছাকাছি।
জীবরান মূলত: দার্শনিক কবি। তাঁর দর্শন তত্ত্বের মূল বক্তব্য আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে জীবনবোধের উন্মেষ সৃষ্টি। জীবন চৈতন্যের সমস্ত উপকরণ আল্লাহ্র সৃষ্টি রহস্যে ব্যাপ্ত। সৃষ্টি রহস্য গভীরভাবে পাঠ করে আল্লাহ্র অস্তিত্বে নিজকে মিশিয়ে দেয়াটাই জীবনের চরম সার্থকতা ও পরম তৃপ্তি। সেই তৃপ্তির মধ্যে নিহিত আল্লাহ্র সান্নিধ্য লাভ। ¯্রষ্টা সৃষ্টির এই সমন্বয় সাধনÑ এই চির সত্যই জীবরান দর্শনের মূল বিষয়বস্তু।
কোনো কবিই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে প্রথমই একটা সিদ্ধান্ত বা জীবনদর্শন দিতে পারেন না। তাকে দর্শন শ্রবণ ও অনুভবের মাধ্যমে অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। জীবরানের যে জীবন দর্শনের কথা বলছি এটা তার সারাজীবন পুড়িয়ে ক্রমে ক্রমে অর্জন।
সায়ীদ আবু বকর প্রবীণ কবি নন, দু’হাতে লিখছেন, নতুন নতুন স্বপ্ন তাঁর চোখে। জগৎ ও জীবনের অনেক পৃষ্ঠা পাঠ করা এখনো তার বাকী। তার সামনের অতি বাস্তব চিত্র- যা দৃশ্যমান, যেমন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমকালীন বিশ্ব নিয়ে তার কবিতার বিষয় উপাত্ত। তবে তার দৃষ্টি ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি অন্যদের মতো নয়Ñ অনেকটা পৃথক। প্রতিনিয়তই নতুনের দিকে তাঁর যাত্রা। একই গাছে কোনো পাখি দু’বার বাসা বাঁধে না। একই বাসায় পাখিরা দু’বার ডিম পাড়ে না। প্রতিবারই নতুন বাসা নতুন আবহে ভ্রমণ করতে চায় উড়ে উড়ে। মহান ¯্রষ্টার নতুন নতুন সৃষ্টি দেখার আকাক্সক্ষা যে পাখিদের সমাজবদ্ধ মানুষের অনেকেরই তা নেই। কবিরা সমাজবদ্ধ হলেও তাদের মন একই ঘাটের পানিতে তৃপ্ত নয়, তারা সৃষ্টি কর্মে ও চিন্তায় ধ্যানে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ছুটে চলেন। যেহেতু জীবন অনন্তের যাত্রী।
কবি সায়ীদ আবু বকর ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত আটটি কাব্যগ্রন্থে যেন একদিগন্ত থেকে নতুন আরেক দিগন্তে ছুটে চলেছেন। অবিরাম তাঁর লেখার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তন। একদিক থেকে আরেক দিকে ভ্রমণ। শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বর্তমানে তিনি এসে থিতু হয়েছেন কাগজ কুসুমে। কী আছে তাঁর এ কাব্যে?
সায়ীদ আবু বকরের ‘কাগজ কুসুম’ কাব্য গ্রন্থ বাংলা কাব্যে বোধ হয় নতুন ধরনের একটি বিষয়। এজন্য এর আলোচনার আগে কবিতা সম্পর্কে গুণীজনদের দু’-একটি অভিমত উল্লেখ করতে হয়। আলোচনা পরিষ্কারভাবে করার জন্যই উল্লেখ প্রয়োজন।
কেউ কেউ বলেন, যথার্থ কবিতার কোনো অর্থ নেই। অর্থাৎ কবিতা পড়তে অর্থ খুঁজে গলদঘর্ম হওয়া বোকামি মাত্র।...
আবার কেউ বলেন, ‘কবিতা সকলের জন্য নয়’।...
আবার কেউ বলেন, কবিতা হতে হবে রুটির মতো সহজ। সবাই যেন তার স্বাদ পেতে পারে।...
আধুনিক দুর্বোধ্য ও অবোধ্য কবিতা সম্পর্কে উ.ঊ. ঝঃরষবিষষ ও কবহহবঃযুড়ঁহম বলেছেন, এসব তো উঁষষ জধননরংয. এসব উঁষষ জধননরংয এখন আর কেউ পড়ে না। তিনি আরো বলেছেন, এসব দুর্বোধ্য আধুনিক কবিতা হচ্ছে পাঠকদের নাকে-মুখে অশ্বের পাছা পায়ের উল্লাম্ফিত লাথি। পশ্চিমবঙ্গের প্রমথ নাথ বিশিও এই রকম কথা বলেছেন।
‘যথার্থ কবিতার কোনো অর্থ নেই।’
এই অভিমত যদি আমরা মেনে চলতে চাই তাহলে মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ প্রমুখকে কী বলবো? তাদের ঠাঁই কোথায়? আর কবিতা যদি এতো রুটির মতো সহজ হয়ে যায় তাহলে সায়ীদ আবু বকর এবং তাঁর মতো কবিদের স্থান কোথায়? আমার মনে হয় এই সকল গুণীজনের অভিমত একতরফা। এই অভিমত দিয়ে কোনো কবির কবিতার ভালো-মন্দ মান যাচাই করা যাবে না। কবিতার স্থায়িত্ব মান ও মূল্যায়ন করবে মহাকাল। তবে সমকালের পাঠকদের যে কবির যেসব কবিতা ভালো লাগবে সেগুলোই ভালো কবিতা হিসেবে গণ্য করতে হবে।
আবু বকরের ‘কাগজ কুসুম’-এর কবিতাগুলোর সুবাস আছে কিনা, নাকি কাগজের ফুলের মতো সুবাসহীন কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। তাঁর কবিতাগুলো ব্যতিক্রমধর্মী। কবি নিজেই তার কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নামটার ভেতরে একটা স্যাটার আছে। এ গ্রন্থটি ভারী পাঠকদের জন্যে, এ কথাটি আমি বিনয়ের সাথে বলতে চাই।’
কাগজ কুসুম ভারী পাঠকদের জন্যে লেখা বলেই হয়তো সাধারণ পাঠকদের জন্যে কবিতাগুলো সম্পর্কে কবি অভিমত ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছেন। কবিতার বই প্রকাশ করে বিভিন্ন রুচির পাঠকদের মতামত পাওয়ার আশায় নীরব থাকাই ভালো কবির পক্ষে। যদি কবিতাসম্পর্কে কবি নির্দিষ্ট মতামত বা নোট দিয়ে দেন তবে পাঠকগণ আর স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারেন না।
সায়ীদ আবু বকর তার এ অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘কাগজ কুসুম’ অন্যান্য কাব্য গ্রন্থ থেকে যে ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন সে সম্পর্কে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আমার একটি কাব্য গ্রন্থকে আরেকটি থেকে পৃথক করে ফেলতে। কিন্তু ‘কাগজ কুসুম’ আমার সবগুলো কাব্য গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা ভাষায় এটি একটি নতুন ধরনের কাব্য গ্রন্থ বলে আমি মনে করি। কিছু কিছু পাঠক অবশ্য আমাকে এ ব্যাপারে অবহিতও করেছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে বলেছেন, এটা আমার দীর্ঘদিনের আধ্যাত্মিকতার ফসল। হতে পারে। তবে আমি বলে রাখি, আধুনিকতা বোধের সাথে আমার কোনো কাব্যের কোনো সংঘর্ষ নেই, কাগজ কুসুম-এরও নেই। এপিকের মতো এর কোনো এক কাহিনী না থাকলেও সবগুলো কবিতা মিলে এটি একটি এপিক পোয়েম। এর একজন স্পিকার আছে। সে সভ্যতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু অবলোকন করেছে তা অবলীলায় ব্যক্ত করতে চায়। তার কথার মধ্যে দর্শন আছে। দেশ আছে, পৃথিবী আছে, মানুষ আছে, মানুষের ইহলৌকিক-পারলৌকিক জীবন-জগৎ আছে। এ স্পিকারকে সরাসরি কবি মনে করলে ঠিক হবে না। সে একটি তৃতীয় চরিত্র।’
কবিদের কথায় রহস্যময়তা থাকে এবং কবিতায় রহস্যময়তা সৃষ্টি করে রাখতে চেষ্টা করেন, এ চেষ্টা করে তারা তৃপ্তি পান। কবিরা কখনো একপক্ষের কথা বলেন না। কারণ, কবি হৃদয়ে একই সময়ে প্রতিফলিত হয় সারা সমাজ সমকাল ও পৃথিবী। সমাজে যতগুলো মানব চরিত্র রয়েছে কবির দৃষ্টি তাদের সবার দিকেই এবং তাদের সবার কথাই বলে থাকেন। এজন্য কবির চরিত্র নাটকের একেক চরিত্রের দশজনের মতো হয়ে থাকে। একজন স্পিকারই দশখানে দশরূপে আবির্ভূত হয়ে দশ রকম ভাষায় কথা বলেন। সে স্পিকারকে বাইরের দর্শক বা শ্রোতাদের কাছে দশরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু মূল নায়ক বা স্পিকার একজনই। কবি আবু বকর বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, ‘এ স্পিকারকে সরাসরি কবি মনে করলে ঠিক হবে না। সে একটি তৃতীয় চরিত্র।’ এ কথা মেনে নেয়া কি করে সম্ভব।
কাব্য গ্রন্থের বিশেষত্ব সম্পর্কে কবি বলেছেন,
‘এ গ্রন্থের বিশেষ বেশিষ্ট্য হলো, পাঠকের কাছে এটাকে একদিক দিয়ে মনে হবে গল্পের মতো, আবার অন্যদিক দিয়ে মনে হবে দর্শনের মতো। বাস্তবিকই, আধুনিক জীবনদর্শনই এ কাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, ধর্মহীনতা, প্রেম, প্রেমহীনতা, যাদুবাস্তবতা প্রভৃতি এ কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।’ কাব্যটি পাঠ করলে কবির কথার সঙ্গে সকল পাঠকই একমত হবেন তাতে সন্দেহ নেই। তবু পাঠকদের সামনে সত্যতা প্রমাণের জন্য সামান্য কিছু অংশ তুলে ধরছি:
মানুষ আমাকে বিপ্লবের কথা বলে।
আমি বলি মানুষের প্রথম বিপ্লব হোক
দেশের দেয়াল ভেঙে ফেলা। সীমান্তের
কাঁটাতার ছিঁড়ে ফ্যালো। অতঃপর বিহঙ্গের মতো
পাসপোর্ট ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ো পৃথিবীর দিকে দিকে। মানুষকে
হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে বলো, আমি মানুষের ভাই।.....
(এক দেশ এক পৃথিবী, পৃ. ৪২)
‘সচিবালয়’ কবিতাটি মাত্র সামান্য কয়টি শব্দ রেখায় অঙ্কিত নিখুঁত নিটোল একটি উজ্জ্বল চিত্র। কবি কত বড় শব্দ শিল্পী:
এতদিন কেবল মানুষই উঠতো এ সিঁড়ি দিয়ে উপরতলায়। কিছু গরু
আজকে হঠাৎ উঠে গেল মানুষের সাথে পাশাপাশি। মানুষের সাথে
কি চমৎকার খোশ গল্প করতে করতে উঠছিল তারা। দেখে বলাবলি করছিল
লোকে, এখনই বরং সুন্দর লাগছে সব; এখনই বরং আদর্শ সচিবালয় বলে
মনে হচ্ছে এ সচিবালয়কে।
(পৃ. সংখ্যা-৬১)
সায়ীদ আবু বকর একজন ব্যতিক্রমধর্মী এবং নতুন নতুন সৃষ্টি কর্মে এডভান্স কবি। তিনি নিত্য নব নব উপাত্ত উপকরণে বাংলা কাব্য ভা-ার সমৃদ্ধ করার চিন্তায় বিভোর। তার রচিত ‘কাগজ কুসুম’ ভাব-ভাষায়, চিন্তা- দর্শনে ও বিষয় উপস্থাপনায় নতুন শব্দ-ছন্দ বাক্য নির্বাচনে শিল্পকর্মের গাঁথুনিতে মজবুত এবং শক্তিশালী একটি কাব্যগ্রন্থ। এ সময়ে এটি উচ্চমানের কাব্যগুণে সমৃদ্ধ ও অতুলনীয় বলতে দ্বিধা নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, কাব্যে ধারণকৃত মূল বিষয়ই দেখা ও বিবেচনার প্রধান বিষয় নয়, প্রধান বিষয় হলোÑ তার পরিবেশনের দিকটি, শব্দ ছন্দময় বাক্য উপমায় উপস্থাপন ও প্রকাশনার চমৎকারিত্বে। দেশ, মাটি, মানুষ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, আনন্দ-বেদনা চিরকাল একই রূপ। জেলের দোকানের সব ইলিশের গুণ একই রূপ। কিন্তু তার স্বাদ নানা রকম রাঁধুনীর গুণে নানা রকম হয়ে থাকে। কাব্য সাহিত্যের বিষয়টিও তেমনি। অতি সাধারণ বিষয় ও ভাবকে অসাধারণ করে তোলার উপরই কবির কৃতিত্ব।
কবি সায়ীদ আবু বকর ধাপে ধাপে কাব্যের সিঁড়ি অতিক্রম করছেন। এটি অবশ্য তার বড় গুণ। তার প্রথম সিঁড়ি ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ থেকে অষ্টম সিঁড়ি কাগজ কুসুমে এসে উঠেছেন। আমরা তার সফলতা কামনা করি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
Source: http://www.dailysangram.com
প্রকাশিত: শুক্রবার ২০ জুন ২০১৪
No comments:
Post a Comment